কোভিড-১৯ রোগের ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে দেশ এক সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ থাকার মধ্যে ঢাকার কয়েকজন কর্মজীবী নারী ও গৃহিনী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের এখন চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা।
কর্মজীবী নারীদের ঘরে বসে অফিসের কাজ করার পাশাপাশি সংসারের কাজ সামলাতে হচ্ছে। পরিবারের অন্য সবাই ঘরে থাকায় গৃহিনীদেরও চাপও গেছে বেড়ে।
মোহাম্মপুরের চাঁন মিয়া আবাসিক এলাকায় স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করেন রোকসানা আক্তার। দুই মেয়ের স্কুল বন্ধ, তাই নিজের জন্য আগে যেটুকু সময় পেতেন, তাও পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
রোকসানা বলেন, “বাসার বুয়া বাদ দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাদের রুটিন পাল্টে গেছে। আগে সব কিছু তারা সময় মেনে করত। এখন সেটা করছে না। ওদের পেছনে আমাকে সময় বেশি দিতে হচ্ছে। আগে বাচ্চারা স্কুলে থাকার সময়ে হয়ত একটু নিজের জন্য সময় পেতাম, এখন সেটাও পাওয়া যায় না।”
‘ঘরবন্দি’ শিশুদের চাই মনের খোরাক
স্বামীর জন্য আগের চেয়ে বেশি চা বানাতে রান্নাঘরেও সময় বেশি ব্যয় হচ্ছে রোকসানার।
ধানমণ্ডি এলাকার নিগার হোসেন বুশরাও বলেন, “আগেও ঘরে শাশুড়ির সাথে রান্নাবান্নায় সাহায্য করতাম। কিন্তু এই সময়টায় সবাই ঘরে থাকাতে একটু পর পর বাড়তি খাবার হিসেবে নাস্তা কিংবা চা বানাতে হচ্ছে।”
বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের কর্মী সাবরিনা সোহানী থাকেন বাড্ডায়। তার ভাষায় নভেল করোনাভাইরাস নারীদের জন্য ‘অভিশাপের মতো’।
তিনি বলেন, “অফিস চলাকালীন আমার সুবিধা ছিলো, একজন সাহায্যকারী ছিলেন। এখন তিনি নেই। তাকে বাসায় আসতে দেওয়া হচ্ছে না। অফিসের কাজ তো আমাকে সময় মতো করতে হচ্ছে, অন্যদিকে ঘরের কাজও রয়েছে।
“কাজের মানুষটি যা যা করে দিত, সব এখন আমাকে করতে হচ্ছে। বিশেষ করে ঘর মোছা, কাপড় ধোয়। এগুলো ভারী কাজ।”
“গৃহিনীদেরও এখন কোনো অবসর নেই। আগে হয়ত একটু হলেও পেত, এখন সেটুকু নেই,” বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে সোহানা বলেন, “বাংলাদেশের পুরুষদের ঘরের কাজের অভ্যাস নেই। তাদের ছোট থেকে সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি। হঠাৎ করে আশা করে লাভ নেই। সে তো অভ্যস্ত নয়। রাতারাতি সমস্যার সমাধান হবে না।”
এক্ষেত্রে ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা জানালেন পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের বিলকিস লাকী।
“এই সময়টায় আমার স্বামীও ঘরের কাজে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করছেন। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে বিকালের চা বানাতে তিনি সাহায্য করছেন। তাই নিজের উপর বাড়তি কোনো চাপ বোধ করছি না, বরং ভালোই লাগছে।”
এই সময়ে সবার একসঙ্গে ঘরে থাকার মজাটাও উপভোগ করছেন লাকী। কারণ তার স্বামী ঢাকার বাইরে সরকারি চাকরি করেন। সপ্তাহের শেষে দুদিনই কেবল পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি, এখন ভিন্ন চিত্র।
“আমার ২৭ বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম ঘরের সবাই মিলে টানা এত দিন একসাথে সময় কাটাচ্ছি।”
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে অতি সংক্রামক এই ব্যাধি ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে অন্য সব দেশের মতো গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ লকডাউনে রয়েছে। আপাতত এই অবস্থা ৯ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে।
অবরুদ্ধ অবস্থায় ঢাকার বাসিন্দাদের জীবন-যাপন বদলে যাচ্ছে, যা গুরুত্বের সঙ্গে দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার এই পরিস্থিতিতে পরিবারের নিজস্ব বন্ধন মজবুত করে ভালো সময় কাটানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উৎকর্ষের জন্য ‘সেলফ কেয়ার’ এর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রয়োজন নিজেকে সময় দেওয়া।
“এক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিৎ প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট হলেও বসে নিজেকে নিয়ে ভাবা। নিয়মিত ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ কিংবা আয়নার সামনে বসে সারাদিন কী করলাম, অথবা কী করবো- এইসব নিয়েও ভাবা উচিৎ।”
“মনে রাখতে হবে এই উদ্বেগের সময়টাতে নিজের সুস্থতা সবার আগে নিশ্চিত করা উচিত। তবেই প্রত্যেক ব্যক্তি পরিবারের জন্য সঠিক দায়িত্বটা পালন করতে পারবে,” বলেন তিনি।