ক্যাটাগরি

মওদুদ কেমন ছিলেন, বললেন শেখ হাসিনা

মওদুদ ‘মেধাবী’ ছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, দেশপ্রেম কাজে লাগালে হয়ত দেশকে অনেক কিছু তিনি দিতে পারতেন বার বার দল বদলানো এই রাজনীতিবিদ।

বৃহস্পতিবার একাদশ সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের শুরুর দিন সিলেট-৩ আসনের এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

তারই এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের সময়ের উপ প্রধানমন্ত্রী, এইচ এম এরশাদের সময়ের উপরাষ্ট্রপতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদের প্রসঙ্গ আসে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আরেকজন ভদ্রলোকের কথা বলতেই হয়- ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। যদিও কখনো ছাত্রলীগ করেননি। তিনি সব সময় একটু সরকার ঘেঁষাই ছিলেন। তবে ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯৬৯ সালে যখন বাংলাদেশে আসেন… জানেন যে তিনি কবি জসীমউদ্দিনের মেয়ের জামাই বলে সব সময় তার প্রতি একটা সহানুভূতি ছিল।

“কিন্তু তার কিছু কিছু কাজ সময় সময় একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। যার কারনে ৭৩ সালে তাকে একবার গ্রেপ্তারও করা হয়। কারণ বাংলাদেশের কিছু গোপন তথ্য সে পাচার করছিল। কবি জসীমউদ্দিন সাহেব নিজে এসেছিলেন আমাদের বাসায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলে তখন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।“

সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৬ মার্চ মারা যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

স্বাধীনতার পর কবি জসীমউদ্দীনের জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদকে দেশের প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল করা হয়েছিল।

পরে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন মওদুদ। বিএনপি গঠনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জিয়া তাকে মন্ত্রী ও পরে উপপ্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর মওদুদ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরেন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে তিনি মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন।

মওদুদ আহমদ, ফাইল ছবি

মওদুদ আহমদ, ফাইল ছবি

এরশাদ সরকারের পতনের পরও জাতীয় পার্টিতেই ছিলেন মওদুদ। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি বিএনপিতে ফেরেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে তিনি আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

বৃহস্পতিবার সংসদে শোকপ্রস্তাবের ওপর আলোচনায় বিএনপির এমপি হারুনুর রশিদ বলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন।

মওদুদ আহমদের জীবনীতে লেখা ওই দাবির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি করা হয়, তখন যে মামলা চলছিল- এখানে অবশ্য তার জীবনীতে (মওদুদ) লেখা আছে তিনি আইনজীবী ছিলেন।

“আসলে তিনি কোনো অ্যাপয়েনটেড আইনজীবী ছিলেন না। তিনি ড. কামাল হোসেন সাহেবের সাথে ঘুরতেন এবং বঙ্গবন্ধুর পিএস মোহাম্মদ হানিফের সাথে ঘুরতেন। তিনি সেই গ্রুপের সাথে সব সময় ছিলেন। বিশেষ করে, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই দুইজন সবসময় একসাথেই চলতেন।

“আমার এখনো মনে আছে, যখন আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকল, এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলায় বন্দি অবস্থায় প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব হল, তখন আমার মা এ বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন মামলা প্রত্যাহার করে মুক্ত মানুষ হিসেবে যেন তিনি যান। তিনি প্যারোলে যাবেন না। এই তথ্যটি আমি মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আমার বাবাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেই ক্যান্টনমেন্টে ভেতরে… সেখানে আমাদের অনেক নেতা তখন উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদ, তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া, আমিরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদসহ আরও নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং সেটাই তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি যখন আমার মায়ের বার্তাটা পৌঁছে দিই, অবশ্য বঙ্গবন্ধু নিজেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাকে মুক্ত মানুষ না করলে তিনি যাবে না।“

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “মায়ের বার্তাটা পৌঁছে বাসায় ফিরে আসার পর দোতলার বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে আছি। আমিরুল ইসলাম ও মওদুদ আমার কাছে আসে। আমার কাছে এসে এ কথাই বলেছিল, এটা আমিরুল ইসলাম সাহেবই বলেছিলেন, আর মওদুদ তাকে সায় দিয়েছিলেন যে ‘তুমি কেমন মেয়ে? তুমি চাও না তোমার বাবা কারাগার থেকে ফিরে আসুক?’

“জবাবে আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ আমার বাবা সম্মান নিয়েই ফিরে আসবেন। আপনারা এ সমস্ত বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। এ ধরনের সব সময় কিছু কিছু কাজ তার (মওদুদ) করা… কিন্তু তিনি মুখে যাই বলুক, আবার তার লেখাগুলির মধ্যে অনেক সময় অনেক বিতর্কিত কথা… আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি লিখেছেন।“

মওদুদ আহমদের দল বদলের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সব সময় তিনি দল বদল করতে পছন্দ করতেন। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ, সেই ৬৯ সালে আমাদের সঙ্গে মিশে গেল। ৭৫ এর পরে বিএনপিতে যোগ দিল। তিনি সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি ছিলেন। জেনারেল এরশাদ সাহেব তাকে ক্ষমা করে দিয়ে মন্ত্রী পরিষদে আইনমন্ত্রী করল। আবার তিনি বিএনপিতে যোগদান করলেন। রাজনীতিতে বার বার দল বদল তার অভ্যাস ছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

“তারপরও বলব, তিনি একটা ট্যালেন্টেড মানুষ ছিলেন, কিন্তু তার দেশপ্রেমে হয়ত কাজে লাগালে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত- এটা হচ্ছে বাস্তবতা।“

মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে শোক জানানোর প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিনি মারা যাওয়ার পর আমি নিজে হাসনাকে (মওদুদের স্ত্রী)… কারণ হাসনার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল; তার সঙ্গে আমি কথা বলি। আমার শোক বার্তাও জানিয়েছি।”