কোভিড-১৯ চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো দায়িত্বশীলরা বলছেন, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে ‘ক্রিটিক্যাল’ রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এমন অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।
তারা বলছেন, রাজধানীর বাইরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) হাসপাতালগুলোর শয্যা ফাঁকা থাকলেও ‘ভাল চিকিৎসার জন্য’ মানুষ ঢাকামুখী হওয়ায় বাড়তি চাপ যোগ হয়েছে।
সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের এই সময়ে অনেকে অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বাসায় নিজেরা চিকিৎসা করতে গিয়ে ভুল করছেন। পরে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ছুটছেন। ফলে বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি ।
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি রোগের তীব্রতায় এবার মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন মিঞা ।
কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ডেমরার আমিন উদ্দিন সরকার। নমুনা পরীক্ষা করতে দিলেও রিপোর্ট মেলেনি তিনদিনেও। এর মধ্যে অবস্থা সংকটাপন্ন হলে আইসিইউ না পেয়ে তাকে নেওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতালে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এবার রোগের তীব্রতা বেশি। আক্রান্ত হওয়ার দুয়েক দিনের মধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশেরই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় মৃত্যু হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, দ্রুত সংক্রমণ বাড়ায় হাসপাতালে সংকট তৈরি হয়েছে। যদি ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়তো, তাহলে অসুবিধা হত না।
“কিন্তু একজন রোগী ভর্তি হলে ১৪ দিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। রোগী তো প্রতিদিনই বাড়ছে। প্রতিদিন যে হারে রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তার ৫ থেকে ১০ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হলে আমরা সিট পাব কোথায়?”
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একদিনে রেকর্ড ৬৬ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৪ জনই ঢাকায়। এক দিনে দেশে ৭ হাজার ২১৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। দুটোই মহামারীর এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা।
গত বছরের ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ২ জুলাই দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়।
চলতি বছর ২৯ মার্চ সে রেকর্ড ছাড়িয়ে ২৪ ঘন্টায় শনাক্ত হয় ৫ হাজার ১৮১ জন। এরপর প্রতিদিনই শনাক্ত রোগী পাঁচ হাজার ছাড়াচ্ছে।
১ এপ্রিল তা আরও বেড়ে ৬ হাজার ৪৬৯ জনে দাঁড়ায়। ৪ এপ্রিল থেকে প্রতিদিনই ৭ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ে দ্রুত বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
গত ৩১ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে প্রতিদিনই ৫০ বা তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে, যা সপ্তাহের হিসাবে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে এক মাসে সর্বোচ্চ ১২৬৪ জনের মৃত্যু হলেও, টানা সাত দিন পঞ্চাশের বেশি মৃত্যুর ঘটনা এবারই প্রথম।
রোগীরা যে একাধিক হাসপাতাল ঘুরে প্রতিদিনের মৃত্যু তালিকায় যোগ হচ্ছেন সেকথা জানালেন তেজগাঁওয়ের ইমপালস্ হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, অনেক হাসপাতাল ঘুরে শেষ মুহূর্তে আইসিইউতে ভর্তির জন্য রোগীরা আসছেন। এজন্য তাদের মৃত্যুর হারটাও বেশি।
“আইসিইউ রিকভারিটা খুব বেশি না। যারা জটিল অবস্থায় যাওয়ার আগে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের রিকভারিটা ভালো।”
এই বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর কতটা চাপ পড়ছে সেটিও ব্যাখ্যা করলেন খাদিজা আক্তার।
“অনেক রোগী আসছে। আমাদের কোনো বেড ফাঁকা নাই; কেবিন, আইসিইউ কোনোটাই ফাঁকা নাই। প্রচণ্ড রোগীর চাপের মধ্যে আছি আমরা। একটা আইসিইউয়ের জন্য ৫টা রোগীর চাহিদা থাকে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সক্রিয় রোগী রয়েছেন ৮৩ হাজার ৮৮৫ জন, যা গত ৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদের মধ্যে ৪ হাজার ৬৯৫ জন সাধারণ শয্যা ও ৪১৭ জন আইসিইউ শয্যায় রয়েছেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডের বুধবার দুপুরের চিত্র। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় হাসপাতালটির কোভিড ওয়ার্ডে কোনো শয্যাই খালি ছিল না এদিন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
ঢাকা মহানগরীর ১৯টি কোভিড হাসপাতালে ২৫টি আইসিইউ শয্যা ও ২৭২টি সাধারণ শয্যা ফাঁকা রয়েছে।
যদিও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারি তথ্যের চেয়ে বেশি রোগীতে রাজধানীর হাসপাতালগুলো পূর্ণ।
তারা বলছেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কার তীব্রতা বেশি হওয়ায় দেশে এখন অন্য সময়ের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ রোগী সবচেয়ে বেশি, যা মৃত্যুর তালিকা লম্বা করছে।
দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা কেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত সপ্তাহেই ঠাঁই মিলছিল না করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের।
চলতি সপ্তাহে ১০ শতাংশের মত রোগী বেড়েছে বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল নাজমুল হক।
তিনি বলেন, “রোগী তো এখন বেড়েছেই। এখন যেহেতু সংক্রমণের হার বেশি, ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যাও বেশি, তাই মৃত্যুর হারটাও বেশি।”
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ডা. শিহাব উদ্দিন জানান, যত সময় যাচ্ছে, তার হাসপাতালে রোগীর ঢল তত বাড়ছে।
“অনেক রোগী আসছে। গত সপ্তাহের তুলনায় ৩০ শতাংশ রোগী বেড়েছে। রোগী ডিসচার্জ হচ্ছে, আবার ভর্তি হচ্ছে। এরকম অবস্থা। সারাক্ষণই রোগী ভর্তি হচ্ছে; আইসিইউ পূর্ণ। সবাই এখন ভর্তি হচ্ছে অক্সিজেনের জন্য।”
গত সপ্তাহের তুলনায় তিনগুণ রোগী বেড়েছে জানিয়ে ইমপালস্ হাসপাতালের সিইও বলেন, এখন আইসিইউতে ৫৬ জন ও জেনারেল বেডে ২০০ জন রোগী ভর্তি আছেন।
“অনেক রোগী আসছে। আমাদের এই জনবলে খুবই হিমশিম খেতে হচ্ছে রোগী সামাল দিতে।”
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের জেনারেল বেডে ৯০ জন ও আইসিইউতে ১৫ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন বলে জানান এ এল ইমরান চৌধুরী।
“এখন সিট ফাঁকা তো দূরের কথা, সিরিয়ালে আছেন ৪৬ জন। আমরা ফোন ধরতে ধরতে ক্লান্ত।”
গত সপ্তাহের তুলনায় ১০ শতাংশ রোগী বেড়েছে জানিয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক ডা. আরিফ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক রোগী ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। ভর্তি নেওয়ার মত জায়গা খালি নেই।”
এখন আক্রান্তদের সুস্থ হতে বেশি সময় লাগছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন রোগীদের বেশি ভোগাচ্ছে করোনাভাইরাস। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে আসছে। দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে।”
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সরকারি এই হাসপাতালটির সব শয্যা পূর্ণ হওয়ায় এখন রোগীদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।
রোগীদের ১০ শতাংশ ‘ক্রিটিক্যাল’ হলেও হাসপাতালটিতে ভর্তি থাকা সবারই অক্সিজেনের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “এখন যে সংক্রমণটা হচ্ছে, সেই সংক্রমণের তীব্রতাটা একটু বেশি। আগে ভাইরাসটা যেমন রোগ সৃষ্টি করত, এখন তার তীব্রতাটা আরও বেশি বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।”
রাজধানীর হাসপাতালগুলো শয্যা সংকটে ধুকতে থাকলেও ঢাকা মহানগরীর বাইরের চিত্র ভিন্ন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মঙ্গলবার যে তথ্য গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে, তাতে দেখা যায় ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৬ হাজার ৩১৮টি সাধারণ শয্যার ৪ হাজার ৭১৯টি ও ২৯০টি আইসিইউ শয্যার ১৫৫টি ফাঁকা রয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডের বুধবার দুপুরের চিত্র। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় হাসপাতালটির কোভিড ওয়ার্ডে কোনো শয্যাই খালি ছিল না এদিন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক জানান, বাইরের রোগীদের কারণে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চাপ পড়েছে।
“ঢাকার ক্রাইসিসটা আসলে ঢাকার না। বাইরের রোগীরা ভাল চিকিৎসার জন্য ঢাকামুখী হওয়ায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে।”
দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বেশি ঝুঁকিতে পড়ছেন বলে জানালেন উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তাদের মৃত্যুর হারটাও বেশি হচ্ছে। আর কোমরবিডিটির ব্যাপারটাও আছে।”
মৃত্যু ঝুঁকিতে পরার পেছনে রোগীদের অবহেলা ও অসতর্কতা রয়েছে বলে করেন বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এল ইমরান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “রোগীরা এখন রোগকে রোগ মনে করছে না, নিজেরাই ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে। প্রথমবার প্যানিকড হয়ে ভর্তি হলেও রোগীরা কিন্তু চিকিৎসা পেয়েছিল।”
তার ধারণা, সংক্রমণের এবারের ঢেউয়ে অনেকে বাসায় থাকছেন, কিন্তু যথাযথ চিকিৎসাটা নিচ্ছেন না তারা। কি পরিমাণ অক্সিজেন লাগবে না জেনে ভুলভাবে চিকিৎসা করছেন।
“বাজারে মেলা অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেশিন অনেক সময় ভুল ফলাফল দেয়। অনেকে দেখেন অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৮ আছে। আসলে এটা ৮০ এর নিচে নেমে গেছে- এটা বেশি হচ্ছে। এটা খুব ভোগাচ্ছে আমাদের।”