তারা বলছেন, রোগী শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে মহামারী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
সোমবার দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ৯৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষার তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে মোট ৭ হাজার ২০১ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে। অর্থাৎ, পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ছিল ২০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রথম এ ভাইরাসের জন্য নমুনা পরীক্ষা হয়। ৮ মার্চ শনাক্ত হয় প্রথম কোভিড-১৯ রোগী।
দেশে এ পর্যন্ত ৫০ লাখ ৩৭ হাজার ৮৩৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৫৭ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। তাতে শনাক্তের হার দাঁড়াচ্ছে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, ১৫ মাসে বাংলাদেশ যত লোকের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষকে মাত্র দুই মাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
পরিসংখ্যান বিষয়ক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, নমুনা পরীক্ষার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ৫০তম। বাংলাদেশে প্রতি ১ মিলিয়ন জনসংখ্যার বিপরীতে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৩০ হাজার ৩৫৪ জনের।
এ তালিকায় এর উপরে থাকা ১৭টি দেশে শনাক্ত রোগী বাংলাদেশের তুলনায় কম হলেও, সেসব দেশে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে বেশি।
তবে মার্চের শেষ দিকে সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়তে থাকায় দেশজুড়ে নমুনা পরীক্ষাও বাড়িয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত দুই সপ্তাহে দেশে ৪ লাখ ২০ হাজার ৮০৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার ৫৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।
রেকর্ড নমুনা পরীক্ষার এই সময়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের রেকর্ডও নিয়মিত ভাঙছে। সংক্রমণের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকায় এই ১৪ দিনের পাঁচ দিনই নমুনা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ২৩ শতাংশের বেশি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে; বুধবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
শনাক্তের হার বেশি থাকায় নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। ঢাকা শহরে অ্যান্টিজেন টেস্ট ব্যাপকভাবে বাড়ানো উচিত, কেননা সংক্রমণ এখন অনেক। অ্যান্টিজেন টেস্ট সেখানেই সফল হয়, যেখানে সংক্রমণটা বেশি।”
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, “এমনভাবে টেস্ট করতে হবে, যেন শনাক্তের হার ১০ এর নিচে থাকে। তাহলে সেটা স্ট্যান্ডার্ড হবে। সেজন্য টেস্টও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সংক্রমণ হয়েছে যাদের, তাদের শনাক্ত করে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা করা গেলে সংক্রমণ ছড়াবে না।”
নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি মহামারী নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য প্রক্রিয়াতেও নজর দিতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টেস্ট বাড়াতে পারলে ভালো। টেস্ট করে আক্রান্তদের আলাদা করে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেলে… ট্রেসিংও তো হচ্ছে না। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিনও মানুষ মানছে না। এটা না মানলে তো হবে না।”
এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, “আমরা নমুনা পরীক্ষা করে যে তথ্যগুলো পাচ্ছি, সে অনুযায়ী কি কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে? যে মানুষগুলো মারা গেল, তারা কেন মারা গেল?
“নমুনা পরীক্ষা যদি বাড়ানো হয়, তাহলে তো সংক্রমণ ১০ শতাংশের নিচে আসবে না। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন করতেই হবে। এখন যাদের করোনাভাইরাস হচ্ছে, সবাইকে কি আমরা আইসোলেট করতে পারছি? পারছি না তো।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে দৈনিক যে তথ্য আসছে, সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা- সেটি বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।
“আমরা প্রতিদিনের নমুনা পরীক্ষা থেকে যে তথ্যগুলো পাচ্ছি, সেখান থেকে দেখতে হবে- সবাইকে আইসোলেশন করা হল কিনা, চিকিৎসা করা গেল কিনা। যারা মারা গেল, তারা কি চিকিৎসা পাওয়ার পরে মারা গেল? নাকি এমনি এমনি মারা গেল? চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেল কি না, অক্সিজেনের সঙ্কটে মারা গেল কি না- এগুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।”
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর অবশ্য দাবি করছেন, কেবল নমুনা পরীক্ষা নয়, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ‘সব ধরনের প্রক্রিয়াই’ অনুসরণ করা হচ্ছে।
সংক্রমণ কমাতে সরকারের পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব ‘দ্রুতই পাওয়া যাবে’ বলেও আশা করছেন তিনি।
“নমুনা পরীক্ষা করে, আইসোলেশন করে, কনট্যাক্ট ট্রেসিং করে সংক্রমণ কমানো একটা ব্যাপার। আরেকটা বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, লকডাউনে থাকতে হবে। অর্থাৎ ট্রান্সমিশন যেখান থেকে হয়, সেখানে সেখানে যাওয়া বাদ দিতে হবে, বা সেগুলো বন্ধ করতে হবে।”
এ এস এম আলমগীর বলেন, “আমরা সমদ্র সৈকতের মত পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে পেরেছি। ১০ দিন হল, একটা ট্রান্সমিশন সাইড বন্ধ হয়েছে। সেগুলোর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে যাবে এই সপ্তাহের ভেতরেই। ৭-৮ দিন হল আন্তঃজেলা যোগাযোগ বন্ধ করতে পেরেছি। ফলে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় সংক্রমণ হচ্ছে না। সেটাও একটা প্রটোকল যে, চলাচল বন্ধ করতে শহরগুলোকে আলাদা করে ফেলতে হবে। সেটাও করা গেছে।
“মাস্ক পরার পরিমাণ তুলনামূলক বেড়েছে, আরও বাড়লে ভালো হয়। আর জনবহুল শহরগুলোতে মানুষ যদি একটু কম বের হয়, যেমন ঢাকায় ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সব কাজগুলো একসাথে করতে হবে। এরকম হাই ট্রান্সমিশন কমানোর জন্য সবগুলো কাজ সম্মিলিতভাবে করতে হয়, এটাই নিয়ম।”