গত বসন্তে করোনাভাইরাস যখন শহরটিতে দাপট দেখানো শুরু করেছিল, ব্রঙ্কসের মন্টেফিওরে মেডিকেল সেন্টারের জরুরি ওষুধ বিভাগের প্রধান ৬৩ বছর বয়সী ওলোউইৎজও তখন আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু ২০১৯ সালের ক্যান্সার চিকিৎসা তার রোগ প্রতিরোধী কোষগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে, দেহকে করে তুলেছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অসহায়।
তাই তো কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়টাতে ওলোউইৎজকে কেবল জুম অ্যাপের মাধ্যমে মেডিকেল সেন্টারের কর্মীদের পরিচালনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে; ওলোউইৎজের ঘনিষ্ঠরা সবাই অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ নিচ্ছেন।
নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার স্ত্রী অস্ট্রিয়ার ন্যাশনাল ব্যালে কোম্পানিতে কাজ করতে দেশটিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। টিকা নেওয়া বন্ধুরাও একত্রিত হওয়া শুরু করেছেন; ওলোউইৎজ কেবল আবহাওয়া ভালো থাকলেই তাদের সঙ্গে বাড়ির পেছনের উঠানে দেখা করতে পারছেন।
বন্ধুদের মতো ৬৩ বছর বয়সী এ চিকিৎসকও টিকা নিয়েছেন; অবশ্য তাতেও ওলোউইৎজের শরীরে কোনো অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না, হবে বলে আশাও করেননি। কেননা, তিনি হচ্ছেন সেই লাখ লাখ আমেরিকানের একজন, যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করে না, তাদের শরীর জানে না কী করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হয়।
এদের অনেকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা ছাড়া কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে জন্মেছেন; অন্যরা হয় কোনো রোগে ভুগে কিংবা থেরাপির কারণে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিসর্জন দিয়েছেন, যেমনটা হয়েছে ওলোউইৎজের ক্ষেত্রেও।
এই ‘ইমিউনকম্প্রোমাইজড’ ব্যক্তিদের মধ্যে কারও কারও শরীরে খুবই সামান্য পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, কারও কারও একেবারেই হয় না, যা তাদেরকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অযোগ্য বানিয়ে দিয়েছে। আক্রান্ত হলে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ভুগতে পারেন, তাদের মৃত্যুর হারও অনেক অনেক বেশি, ৫৫ শতাংশ।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ঘাটতি নিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা এ ব্যক্তিদের অধিকাংশই তাদের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত; কারও কারও আবার প্রতিষেধক যে তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই।
“তারা বাইরে হেঁটে বেড়ান, মনে করেন যে তারা নিরাপদ, কিন্তু তেমনটা নাও হতে পারে,” বলেছেন লিউকেমিয়া অ্যান্ড লিম্ফোমা সোসাইটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. লি গ্রিনবার্গার।
ভাইরাসকে হটিয়ে দেওয়া পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে লুকিয়ে রাখা ছাড়া এ ‘ইমিউনকম্প্রোমাইজডদের’ হাতে উপায় থাকে কেবল একটা। তা হলো- নিয়মিত রিরতিতে শরীরে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি নেওয়া।
কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের দেহে এ অ্যান্টিবডি বিপুল পরিমাণ তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে করা বেশ কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতির অনুমোদনও দিয়েছে।
সুস্থ মানুষের কাছ থেকে নেওয়া বিশুদ্ধ অ্যান্টিবডি কনভালেসেন্ট প্লাজমা বা গামা গ্লোবুলিনও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যক্তিদের উপকারে আসতে পারে।
মহামারী বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত কিংবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন অনেকেই বিপাকে পড়বেন বলে চিকিৎসকরা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন।
নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাইয়ে অবস্থিত আইকান স্কুল অব মেডিসিনের রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ ড. শার্লট কানিংহাম-রানডলস এমন ৬০০র মতো রোগীর চিকিৎসা করতেন, যাদের সবাই গামা গ্লোবুলিনের নিয়মিত ডোজের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন।
এর মধ্যে এই রোগীদের ৪৪ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরও ৪-৫ জনের যে শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে ভুগতে হবে অনেকদিন।
কানিংহাম-রানডলসের রোগীদের একজন স্টিভেন লোটিটো। ১৩ বছর বয়সেই তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ঘাটতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
তা সত্ত্বেও মহামারীর আগ পর্যন্ত লোটিটোর জীবনযাপন ছিল দুশ্চিন্তামুক্ত। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া ও ব্যায়াম করতেন।
“আমার শরীরের যে বিশেষ যত্ন প্রয়োজন, তা জানতাম আমি,” বলেছেন ৫৬ বছর বয়সী এ ব্যক্তি। তাকে প্রতি তিন সপ্তাহ পরপর গামা গ্লোবুলিন নিতে হয়।
ব্যাপক সাবধানতা অবলম্বন সত্ত্বেও গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি মেয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন লোটিটো। মাসখানেকের মতো জ্বর ছিল তার, হাসপাতালেও এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছে।
কনভালেসেন্ট প্লাজমা ও রেমিডিসিভির তাকে কয়েক সপ্তাহ স্বস্তি দিলেও পরে আবারও জ্বরে পড়েন তিনি। শেষ পর্যন্ত এক ডোজ গামা গ্লোবুলিন তাকে সুস্থ করে তোলে।
এরপর ৭ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও লোটিটোর শরীরে এখনও করোনাভাইরাস প্রতিরোধী কোনো অ্যান্টিবডির দেখা মেলেনি।
“আমি এখনো সেসব সতর্কতাই মেনে চলি, এক বছর আগেও যা মানতাম। আপনার পরিবারের সবাই এবং আপনার ঘনিষ্ঠ সহচররা ভ্যাকসিন নিয়ে এসে হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে, এমনটাই আপনি আশা করতে পারেন.” বলেছেন তিনি।
লিউকেমিয়া অ্যান্ড লিম্ফোমা সোসাইটি এখন একটি নিবন্ধন কার্যক্রম চালাচ্ছে যেখানে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্তদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছে।
ক্যান্সার, রিমেটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এ জাতীয় রোগে আক্রান্ত কিংবা যারা এমন ওষধু নিচ্ছেন যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিস্ক্রিয় করে রেখেছে, তাদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কেমন কাজ করছে তা দেখতে বেশ কয়েকটি গবেষণাও চলছে।
২৮ বছর বয়সে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতির বিষয়টি জানতে পারেন ওয়েন্ডি হালপেরিন। এখন তার বয়স ৫৪। জানুয়ারিতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ১৫ দিন থাকতেও হয়েছিল তাকে।
“আমার হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিল। পায়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি আর রাস্তায় হাঁটতে পারবো না,” সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন এ নারী।
কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কনভালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহার করায় হালপেরিনকে টিকা নেওয়ার জন্য তিন মাস অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে, তার টিকা নেওয়ার তারিখ পড়েছে ২৬ এপ্রিল।
কিন্তু এর মধ্যেই তার শরীর কিছু অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলেছে, যা চিকিৎসকদের অবাক করে দিয়েছে।
“এখান থেকে যে বার্তাটা নিতে হবে, তা হচ্ছে সবারই চেষ্টা করা উচিত এবং ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত,” বলেছেন মন্টেফিওরে মেডিকেল সেন্টারের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অমিন ভার্মা।
অবশ্য এ জুয়া ওলোউইৎজের ক্ষেত্রে কাজে লাগেনি। নিজেকে সুরক্ষিত করার মতো অ্যাস্টিবডি না থাকায় এখনও বাসা থেকেই কাজ করছেন এ চিকিৎসক, যে সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞও তিনি।
পাহাড়ে সাইক্লিং ও স্কি করার ব্যাপক শখ তার। স্বাভাবিক জীবনে একদিন ফিরবেনই, এ আকাঙ্ক্ষায় ওলোউইৎজ এখন তার সাইকেলগুলোর সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক আছে কিনা, তা নিয়মিত চেক করছেন। অন্য সবার ভ্যাকসিন না নেওয়া পর্যন্ত এবং শহরে সংক্রমণের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামার আগ পর্যন্ত এভাবেই যে তাকে কাটাতে হবে, তাও জানেন তিনি।
“আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই, কবে সে দিনটি আসবে। বাইরে বের হওয়ার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি,” বলেছেন ওলোউইৎজ।