পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের প্রস্তাব নাকচ করে যে সিদ্ধান্ত দেশটির ডেপুটি স্পিকার দিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট তাকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে বাতিল করে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আহ্বানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে জাতীয় পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করে শনিবার অধিবেশন শুরুর পাশাপাশি আস্থা ভোটের ফয়সালা করার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ।
অর্থাৎ, ক্রিকেট মাঠ থেকে রাজনীতিতে এসে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া ইমরান খানকে এখন আইনসভায় আস্থার প্রমাণ দিতে হবে, যেখানে তার হার আগেই এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে আছে।
৩৪২ আসনের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অন্তত ১৭৩ জন সদস্যের সমর্থন পেতে হবে। কিন্তু তার বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব তোলার আগেই ১৭৭ জন সদস্যের সমর্থন জড়ো করে রেখেছে।
সেই লজ্জা এড়াতে পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক গত ৩ এপ্রিল অভাবনীয় এক রাজনৈতিক কৌশলের মঞ্চায়ন ঘটান, যাকে সংবাদ শিরোনামে ক্রিকেট মাঠের গুগলি বলের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ক্ষমতাসী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার হওয়া কাসিম খান সুরি অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব বাতিল করে দেন এবং ইমরান খানের আহ্বানে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। যার পরিণতিতে পাকিস্তানের সামনে আবির্ভূত হয় এক সাংবিধানিক সঙ্কট।
বিরোধীদলগুলো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভাগ্য চলে যায় আদালতের হাতে।
ছবি: রয়টার্স
কী বলেছে আদালত?
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন লিখেছে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় দেওয়ার কথা ছিল স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। সেজন্য সেদেশের জনগণের মত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের সেই সিদ্ধান্ত আসে এক ঘণ্টা দেরিতে।
জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণার সময় প্রধান বিচারপতি জানান, পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ আলোচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
বিচারপতি বান্দিয়াল বলেন, অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব ওঠার পর ২৮ মার্চ অধিবেশন মুলতবি করা হয়েছিল। ডেপুটি স্পিকার ৩ এপ্রিল ওই প্রস্তাব বাতিল করে দেন। তার ওই রুলিং ছিল ‘অসাংবিধানিক’।
পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের পর স্পিকারকে ১৪ দিনের মধ্যে অধিবেশন ডাকতে হয়। কিন্তু সে সময় ইসলামাবাদে ওআইসি দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের কারণে সেই তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ২৫ মার্চ পার্লামেন্ট অধিবেশন ডাকা হলেও সেদিন অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন না করেই ২৮ তারিখ পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়। ২৮ মার্চের অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাব তোলেন বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ।
সংবিধান অনুযায়ী প্রস্তাব উত্থাপনের পর তিন দিন পার হলেই ভোট করা যায়। তবে ভোটাভুটির জন্য সাত দিনের বেশি সময় নেওয়া যায় না। কিন্তু ২৮ তারিখ প্রস্তাব উত্থাপনের পর আবার ৩১ মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি।
এরপর ৩ এপ্রিল অধিবেশন শুরুর দিনই নাটকীয় পরিস্থিতিতে সেই প্রস্তাব বাতিল করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানেরে আহ্বানে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
কিন্তু হার মানতে নারাজ বিরোধী দলগুলো সুপ্রিম কোর্টে যায়। তাদের বক্তব্য ছিল, ডেপুটি স্পিকারের সিদ্ধান্তে সংবিধান ও গণতন্ত্র ভূলণ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে ইমরান অভিযোগ তোলেন, রাশিয়া আর চীনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের জেরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে তাকে উৎখাতের এই চক্রান্ত সাজিয়েছে বিরোধী দলগুলো।
পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং অনাস্থা প্রস্তাব বাতিলের পদক্ষেপ সাংবিধানিক কিনা সেই প্রশ্নে তিন দিনের শুনানির পর বৃহস্পতিবারে রায় এল।
সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেছে, ডেপুটি স্পিকারের অনাস্থা প্রস্তাব বাতিলের রুলিং সংবিধান ও আইন পরিপন্থি। আইনগতভাবে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত হয়নি। তাকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নেই।
প্রধান বিচারপতি আদেশে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ তার মন্ত্রিসভাকে পুনর্বহাল করতে হবে। শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ডাকতে হবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করা যাবে না।
আদালত বলেছে, পার্লামেন্টের অধিবেশনে কোনও এমএনএ’র অংশগ্রহণে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এবং সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আদালতের আদেশ পার্লামেন্টের প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।
আদালতের এ রায়কে গণতন্ত্রের জয় হিসাবেই দেখছে বিরোধীরা। পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল মুসলিম লিগের (এন) নেতা শাহবাজ শরিফ রায়ের পর গণমাধ্যমকে বলেন, “আদালত নিশ্চিতভাবেই মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করেছে।”
আরেক বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেছেন, “আদালতের রায় গণতন্ত্র এবং সংবিধানের জয়। আল্লাহর ইচ্ছায় এবার অনাস্থা প্রস্তাবের প্রক্রিয়া শেষ হবে। আমরা নির্বাচনী সংস্কারের কাজে হাত দেব এবং একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাব।”
রয়টার্স লিখেছে, রায়ের পর আদালতে বাইরে উল্লাসে মেতে ওঠেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। দাঙ্গা পুলিশের ব্যারিকেডের অন্য পাশ থেকে ইমরান সমর্থকরা আমেরিকা বিরোধী স্লোগান তুলে তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেন।
পতনের পথ
দুর্নীতি ঠেকানো ও অর্থনীতিকে ঠিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসেন ইমরান খান। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই ঠিকভাবে পূরণ করে উঠতে পারেননি। তার ওপর মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার আর বিদেশি ঋণের বিপুল বোঝার কারণে দ্রুত জনসমর্থন হারাতে থাকে ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ শতাংশ, একই সময়ে পাকিস্তানে তা ছিল ২৩ শতাংশ। মহামারী সামাল দিয়ে প্রশংসা পেলেও বাজার সামলাতে না পারায় ইমরানের গদি ছাড়ার দাবি জোরদার হতে থাকে।
ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাধ পূরণ হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হলে তার বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, বর্তমান সংকটের শুরু গত অক্টোবরে, যখন প্রধানমন্ত্রী খান পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নতুন প্রধানের নিয়োগপত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি সামরিক বাহিনীর পছন্দ করা ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে বাধ্য হন, কিন্তু ততক্ষণে মাঠ অনেকটা বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে দুইবার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে বেনজির ভুট্টো এবং ২০০৬ সালে শওকত আজিজকে সেই পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছিল এবং তারা দুজনই তাতে উৎরে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এবার পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হলে ইমরানের উইকেট যে টিকবে না, সে বিষয়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ভরাডুবির মুখেও তিনি জোর গলায় বলে আসছিলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না।
পদত্যাগ কিংবা আস্থা ভোটের পরাজয় এড়াতেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনে যাওয়ার কৌলশ নিয়েছিলেন ৬৯ বছর বয়সী ইমরান খান। কিন্তু আদালতের হস্তক্ষেপে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
এখন তিনি আস্থাভোটে হেরে উৎখাত হতে পারেন, কিংবা পদত্যাগ করে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বিদায় নিতে পারেন। ফল যাই ঘটুক, পাকিস্তানে কোনো প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে না পারার রেকর্ড অক্ষুণ্ন থাকবে।
আর যদি তিনি ‘অলৌকিকভাবে’ আস্থা ভোটে জিতে যান? এত কিছুর পর সেই সম্ভাবনা কেউ আর দেখছেন না।
রয়টার্স লিখেছে, ইমরানের দল আস্থা ভোটে হেরে গেলে বিরোধী দলগুলো জোট গড়ে তাদের একজন প্রার্থীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করতে পারবে এবং ২০২৩ সালের অগাস্টে বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে।
বৃহস্পতিবার রায়ের পর প্রধান বিরোধী দল মুসলিম লীগের (এন) নেতা শাহবাজ শরিফ তার জোটসঙ্গীদের পাশে রেখে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শরিকরা তাকেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী মনোনীত করেছেন।
বিরোধী দলগুলো অবশ্য এর আগে আগাম নির্বাচনের দাবিই জানিয়ে আসছিল। তারা মূলত পার্লামেন্টে ইমরানের রাজনৈতিক পরাজয়টা নিশ্চিত করতে আদালতে গিয়েছিল।
আর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনও বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিয়েছে, অক্টোবরের আগে তারা ভোটের আয়োজন করতে পারবে না।
এদিকে আদালতের রায়ে মন্ত্রিসভা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর শুক্রবার মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাশাপাশি দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গেও তিনি বসবেন। বিকালে তিনি ভাষণ দেবেন জাতির উদ্দেশে।
এক টুইটে ইমরান লিখেছেন, দেশের মানুষের প্রতি এটাই আমার বার্তা, “সবসময় যা করে এসেছি, ভবিষ্যতেও তাই করব। শেষ বল পর্যন্ত পাকিস্তানের জন্য লড়ে যাব।”
I have called a cabinet mtg tomorrow as well as our parl party mtg; & tomorrow evening I will address the nation. My message to our nation is I have always & will continue to fight for Pak till the last ball.
— Imran Khan (@ImranKhanPTI) April 7, 2022
পুরনো খবর
সব সংবিধান অনুযায়ী হলে সংকট কোথায়: পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি
৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব নয়: পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন
ডেপুটি স্পিকারের আদেশ ভ্রান্ত ছিল এটি পরিষ্কার: পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি
সুপ্রিম কোর্টে ইমরানের ভাগ্য নির্ধারণ ফের পেছাল
সুপ্রিম কোর্টে ইমরানের ভাগ্য নির্ধারণ ফের পেছাল
‘অবাধ্য’ ইমরান খানকে শাস্তি দিতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র: রাশিয়া
পাকিস্তানে অনাস্থা প্রস্তাব: পার্লামেন্টের কার্যবিবরণী চাইল সুপ্রিম কোর্ট
পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব বাকি বিশ্বে কতটুকু
সুপ্রিম কোর্টেই ঝুলে ইমরানের ভাগ্য
পাকিস্তান আবারও জটিলতার আবর্তে
ইমরান খানের ‘গুগলি’: অনাস্থার নাটকীয়তা শেষে ভোটের পথে পাকিস্তান
ইমরান খানের রাজনীতির ইনিংস ঝুলছে সুতোয়