গত ৯ মার্চ ইইউ-এর নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ওঠে রাশিয়ার কয়লা ও সার ব্যবসায়ী মেলনিচেঙ্কোর নাম। তার চারদিন পর ইতালি কর্তৃপক্ষ মেলনিচেঙ্কোর আরও একটি সুপারইয়ট জব্দ করে। ইতালিতে জব্দ হওয়া ওই প্রমোদতরী বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘সেইলিং ইয়ট’। সেটির অর্থমূল্য ৫৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার।
নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতালি কর্তৃপক্ষ প্রমোদতরী জব্দ করলেও মালদ্বীপে মেলনিচেঙ্কোর প্রমোদতরীর একই পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা। যাদের মধ্যে সরকারি মন্ত্রী, কূটনীতিক এবং দেশটির সুপারইয়ট শিল্পের বিশেষজ্ঞরাও রয়েছেন।
ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করতে দেশটির ধনকুবেরদের উপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ব্যাপারে সতর্ক পন্থা অবলম্বন করেছে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ কর্তৃপক্ষ। সেকারণে ইয়টের মালিক রুশ ধনকুবেরদের জন্য তাদের বিলাসবহুল জলযান লুকিয়ে রাখার আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে মালদ্বীপ।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মেলনিচেঙ্কোর মত আরও পাঁচ রুশ ধনকুবেরের ইয়ট মালদ্বীপের প্রবালপ্রাচীরে ভেসে বেড়িয়েছে। সেগুলোর মধ্যে তিনটি তাদের বর্তমান স্পষ্ট করেনি, পূর্বঘোষিত গন্তব্য পরিবর্তন করেছে অথবা আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলে গেছে বলে জানিয়েছে মেরিন ট্রাফিক।
মালদ্বীপের বর্তমান আইন ওইসব প্রমোদতরী জব্দ করার জন্য যথেষ্ট বলিষ্ঠও নয়। দেশটির প্রধান কৌসুলি হুসেইন শামীম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, স্থানীয় আইনের অধীনে পড়ে এমন কোনও অপরাধ সংঘটিত না হলে কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনকারী জলযানগুলোকে সহজে জব্দ করতে পারে না।
মেলনিচেঙ্কোর ৩৯০ ফুট লম্বা ‘মোটর ইয়ট এ’ তে ক্রিস্টালের আসবাবপত্র এবং তিনটি সুইমিং পুল রয়েছে বলে জানিয়েছেন এটির নির্মাতারা। মেলনিচেঙ্কোর স্ত্রী এটির ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছেন। এটির মূল্য ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
নিরাপদ স্বর্গ:
ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব রুশ ধনকুবেরদের সম্পদের গলা টিপে ধরার যে পরিকল্পনা করেছিল, তা বাস্তবায়নে তাদের বেশ অসুবিধার মুখে পড়তে হচ্ছে। কারণ, মালদ্বীপের মত অনেক দেশ এখনও তাদের সম্পদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য এবং ব্যবসায়ীদের উপর বিস্তৃত মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ওই নিষেধাজ্ঞার অধীনে ইইউভুক্ত দেশগুলো রুশ ধনকুবেদের বিলাসবহুল বাড়ি এবং জলযান জব্দ করছে।
কিন্তু মালদ্বীপের মত দেশ যারা ইইউ ভুক্ত নয় বা কোনও জোট ভুক্ত নয়, তারা ওই নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করতে বাধ্য নয়।
যদিও মালদ্বীপ জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে এবং ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে প্রকাশ্যে সহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবতা হল, পর্যটন নির্ভর দেশ মালদ্বীপের কর্মকর্তারা রাশিয়ার ধনকুবের পর্যটকদের বাধা দিলে নিজেদের অর্থনীতির উপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে সেটি নিয়ে খুবই সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
সাদা বালুর সৈকত আর ১২শ’র বেশি ছোট ছোট মানুষবিহীন দ্বীপের দেশ মালদ্বীপ বিশ্বের তাবৎ ধনকুবেরদের অবকাশ যাপনের প্রিয় স্থান।
মালদ্বীপের ৫৬০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। অন্য পর্যটকরা সেখানে গড়ে যা খরচ করে, রাশিয়ার নাগরিকরা তারচেয়ে বেশি ব্যয় করে।
এছাড়া, এ বছর জানুয়ারিতে মালদ্বীপে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে রুশরাই ছিল সর্বোচ্চ। ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে রুশ পর্যটকদের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। মালদ্বীপের পর্যটনমন্ত্রী আব্দুল্লাহ মৌসুম বলেন, তিনি চান আবার আগের অবস্থা ফিরে আসুক।
“আমাদের প্রবেশ নীতি খুবই উন্মুক্ত। মালদ্বীপ একটি উন্মুক্ত দেশ। তাদেরকে কেউ ছুঁতেও পারবে না।”
‘সিল সুপারইয়ট মালদ্বীপ’ নামে একটি কোম্পানি পরিচালনা করেন আব্দুল হান্নান। তার কোম্পানি মূলত বিলাসবহুল জলযানে জ্বালানি এবং খবার সরবরাহ করে।
হান্নানের খদ্দেরদের মধ্যে রুশরাও আছেন। হান্নান বলেন, “এই সব ইয়টে এক সপ্তাহেই লাখ লাখ ডলার খরচ হয়। তার খদ্দেরদের প্রায় অর্ধেক রুশ বলে জানান হান্নান।”
“অন্যান্য ইয়ট মালিকদের মত তারাও শীতে ভারত মহাসাগরে এবং গরমে ইউরোপে কাটান।”হান্নান দাবি করেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তিনি কয়েকজন ইয়ট মালিকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন।
তাদেরকে তিনি ‘ভদ্র এবং সাধারণ মানুষ’ বলে বর্ণনা করেন। যারা এখন একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তারা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছেন কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।
“কিছু সময়ের জন্য তারা তাদের প্রমোদতরী আন্তর্জাতিক জলসীমায় রাখতে চেষ্টা করছেন। সেখানে তারা সম্ভব হলে একটানা কয়েক মাসের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকতে চান। তারপর, কেউ তাদের আর ছুঁতেও পারবে না।”
এ বিষয়ে জানতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পক্ষ থেকে মালদ্বীপের কাস্টম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।