এছাড়া শহরের তিনটি প্রবেশমুখে বাস টার্মিনাল না থাকা এবং বন্দরকেন্দ্রিক যানজটে নাগরিক এই সমস্যা পোঁছে গেছে অসহনীয় পর্যায়ে।
দিনরাতের অনেকটা সময়জুড়ে বিভিন্ন পরিবহনে রাস্তা স্থবির হয়ে থাকায় এক সময়ের ‘যানজটমুক্ত’ শহর হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে ‘যানজটের’ শহর।
বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে পরিদর্শন ও ট্রাফিক বিভাগের প্রাথমিক জরিপ থেকে চট্টগ্রাম নগরীর যানজটের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
শেষ কয়েক দশকে শহরের ভেতরে নতুন কোনো সড়ক তৈরি না হওয়া এবং যানবাহনের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হওয়া এই সমস্যার এই কারণ বলছেন ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন। পাশাপাশি বন্দরের আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে।
নতুন নতুন মার্কেট ও হাসপাতাল গড়ে উঠলেও সেগুলোতে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা নেই।
শহরের নিউ মার্কেট মোড় থেকে জুবলী রোড এলাকায় রেয়াজউদ্দিন বাজার, পৌর জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকমুন্ডি লেইন এবং শাহ আমানত সিটি করপোরেশন মার্কেট, গোলাম রসুল মার্কেট ও পাইকারী সবজি বাজার, কোনো এলাকাই এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়।
এসব এলাকায় ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় যানবাহন থেকে যাত্রী এবং মালামাল ওঠানামা সবকিছুই হয়ে থাকে সড়কে। যানবাহন রাখা হয় এলাপাথাড়িভাবে। নিউ মার্কেট ছাড়া আর কোনটিতেই নেই পার্কিং ব্যবস্থা।
যানজটে স্বল্প দূরত্বেও রক্ষা নেই চট্টগ্রামে
প্রবেশ পথে নেই বাস টার্মিনাল
একে খান, অক্সিজেন, শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন বশিরুজ্জামান চত্বর ও কাপ্তাই রাস্তার মাথা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় চট্টগ্রাম নগরে।
এরমধ্যে একে খান মোড় দিয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর এবং দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন চলাচল করে। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রবেশপথে কোনো টার্মিনাল না থাকায় যানজট লেগেই থাকে।
অক্সিজেন মোড়েও কোনো টার্মিনাল না থাকায় রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির বাসগুলোর অঘোষিত টার্মিনাল হয়ে পড়েছে এ মোড়টি।
শাহ আমানত সেতু দিয়ে কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের আসা-যাওয়া এবং কাপ্তাই রাস্তার মাথা দিয়ে কাপ্তাই, রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়ার যানবাহন চলাচল করে। এখানেও কোনো টার্মিনাল তৈরি করেনি নগর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম নগরীতে চান্দগাঁও এলাকা ছাড়া কোন স্থানে টার্মিনাল না থাকায় শহরে ঢোকার তিন রাস্তাতেই প্রতিদিন যানজট তৈরি হয়।
ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার তারেক আহম্মেদ বলেন, “অলঙ্কার, একে খান মোড়ে কোনো টার্মিনাল না থাকায় সেটা অলিখিত বাস স্টেশন হয়ে গেছে। সেখানে বিভিন্ন যাত্রীরা উঠানামা করার কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়।”
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. মুছা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সড়ক গণপরিহন কিংবা অন্যান্য যানবাহনের জন্য। কিন্তু চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তা না। নগরীর সড়ক ও ফুটপাতগুলো বিভিন্ন ভাসমান হকার ও ভ্যান গাড়ির দখলে। সেখানে যানবাহন চলবে কিভাবে?”
নগরীতে বাস টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে মুছা বলেন, বাস টার্মিনাল থাকলে যানজট অনেকটা সহনীয় হত। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে অনেক খাস জমি থাকলেও সেগুলো টার্মিনাল নির্মাণের জন্য দেওয়া হচ্ছে না।
লালদিঘী থেকে আন্দরকিল্লা: পার্কিং সড়কেই
টেরিবাজার এলাকায় কাপড়ের বৃহৎ পাইকারী বাজার ছাড়াও গড়ে উঠেছে বেশকিছু বিপণি বিতান। রয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বই মার্কেট, কাগজের মার্কেটও।
বছর দশেক আগে চট্গ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই সড়কটি বড় করে, সে সময় আশেপাশে বিভিন্ন ভবনও ভাঙাও পড়েছিল। কিন্তু সেই কাজের তেমন সুফল মেলেনি।
টেরিবাজারে বাজারের সরু রাস্তা এবং কোনো মার্কেটেই পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় পথচারীদের চলাচল ও মালামাল ওঠানামা সবই চলে সড়কে।
কোভিড মহামারীতে প্রায় দুবছর ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুরো পুরোদমে খুলে গেছে মার্চের মাঝামাঝি থেকে। এই কারণটিও যানজট বাড়িয়ে দিয়েছে।
আর সাধারণ সময়ে জামালখান-কাজীর দেউড়ি সড়ক, চকবাজার, চেরাগী পাহাড়-বৌদ্ধ মন্দির-লাভলেইন সড়ক, রাইফেল ক্লাব-ডিসি হিল, জুবিলী রোডে যানজট নিয়মিত ঘটনা। এই সড়কগুলো চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের চারটি জোনের মধ্যে দক্ষিণ জোনের আওতাধীন।
ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার নাসির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসব এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই বেশ কিছু মার্কেট। এসব মার্কেট তৈরি হয়েছে পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়াই। মার্কেটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা রাস্তার উপর গাড়ি থেকে উঠানামা করছে। আবার সড়কেই মালামাল উঠানামা করানো হচ্ছে।”
হকারদের পুনর্বাসন করে ফুটপাতমুক্ত করতে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেও কাজ হয়নি বলে জানান উপ-কমিশনার নাসির উদ্দিন।
“ফুটপাত দখলে থাকায় পথচারীরা সড়কে হাঁটছে। এতে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।”
উত্তর জোনের জাকির হোসেন সড়কে সকাল-দুপুরের যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। পাশাপাশি জিইসি মোড়, গোলপাহাড়, প্রবর্ত্তক, ষোলশহর মোড়ও যানজটমুক্ত নয়।
‘অবৈধ পার্কিং’কে এই এলাকার যানজটের বড় কারণ বলছেন ট্রাফিক উত্তর জোনের উপ-কমিশনার জয়নুল আবেদীন।
গোলপাহাড়, প্রবর্ত্তক মোড়ে গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তাই এসব এলাকায় রোগীদের নিয়ে আসা যানবাহনের চাপ লেগেই থাকে, ফলে তৈরি হয় যানজট।
যানজটের কারণ খুঁজতে গিয়ে সম্প্রতি ট্রাফিক উত্তর বিভাগ ষোলশহর ২ নম্বর গেইট থেকে প্রবর্ত্তক মোড় ও সিডিএ অ্যাভিনিউর দুই পাশের একটি জরিপ চালিয়ে ৬৬টি ক্রুটিযুক্ত স্থাপনা চিহ্নিত করেছে।
দেখা গেছে এই ৬৬টির মধ্যে এর মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টারসহ ৩৩টি স্থাপনারই কোনো পার্কিং ব্যবস্থা নেই।
ট্রাফিক উত্তর বিভাগের পক্ষ থেকে এ নিয়ে সিডিএ’কে একটি চিঠিও দেওয়া হয়।
উপ-কমিশনার জয়নুল আবেদীন বলেন, বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার হয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত র্পাকিং ব্যবস্থা নেই।
“আমরা হাসপাতালগুলোর মালিক পক্ষকে বলেছি যাতে তারা তাদের পার্কিং স্থানগুলো উন্মুক্ত করে রাখে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য।”
এদিকে ষোলশহর থেকে মুরাদপুর এলাকা পর্যন্ত সড়কে দায়িত্বরত একাধিক ট্রাফিক সদস্য জানায়, ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও খাল থেকে তোলা করা মাটি রাস্তার ওপরেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে। যার কারণে রাস্তা সরু হয়ে পড়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
বন্দরের ট্রাক-লরির রাস্তায় অপেক্ষা
বন্দরের সড়ক দিয়ে বিমানবন্দর, সিইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় লাখো মানুষের চলাচল। কিন্তু বন্দরে ঢোকার জন্য ট্রাকসহ মালবাহী যানের দীর্ঘ লাইন সড়ক সুরু করে তৈরি করছে যানজট।
বর্তমানে এ সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ যানজট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বন্দর বিভাগ তাদের জরিপে বন্দরকেন্দ্রিক যানজটের জন্য ১৫টি কারণ নির্ণয় করেছে।
তার মধ্যে একটি হল বন্দর ব্যবহারকারী ট্রাক, কভার্ড ভ্যান, প্রাইমমুভার পার্কিংয়ের জন্য কোনো টার্মিনাল নেই।
বাংলাদেশ কভার্ড ভ্যান, ট্রাক, প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহম্মে বলেন, “দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহনগুলো বন্দরে প্রবেশের পূর্বে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে সড়কের এক পাশে পার্কিং করে রাখতে হচ্ছে।”
সাধারণ মানুষ, শ্রমিক ও বিদেশযাত্রীদের ভোগান্তির কথা স্বীকার করেই তিনি বলেন, কিন্তু গাড়িগুলো সড়ক ছাড়া রাখার বিকল্পও নেই তাদের কাছে।