ক্যাটাগরি

ডুবেছে চাপতির হাওর, গ্রামে-গ্রামে মাতম

বুধবার ভোর রাতে ফসল রক্ষা বাঁধ (স্থানীয়ভাবে যা `বৈশাখীর খাড়া’ বা `গহীন কোড়’ নামে পরিচিত) ভেঙে হাওরে পানি ডুকতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে পুরো হাওরের ধান জলের পেটের মধ্যে চলে যায়।

উপজেলার তাড়ল, জগদল ও করিমপুর ইউনিয়নের কৃষকরা এই হাওরে চাষ করেন। চোখের সামনে দেখতে দেখতে তলিয়ে গেছে তাদের ধান, সারা বছরের স্বপ্ন। ফসল হারিয়ে এখন হাওরপাড়ের গ্রামে গ্রামে চলছে মাতম।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব চন্দ্র সোম বলেন, “এ মৌসুমের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চাপতির হাওরে। এই হাওরে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

এ বছর এই হাওরে চার হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। এ পর্যন্ত জেলায় মোট চার হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে।”

জেলার মোট ১৩৭টি হাওরে চাষ হয়েছে। এখানে কৃষির সঙ্গে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৭০৫টি পরিবার জড়িত।

“হাওর ডুবলে কৃষক বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েন। কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখছে। এখন জেলার ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, “বৈশাখীর বাঁধ পাউবোর প্রকল্পভুক্ত। এখানের হাওরের অংশটা অনেক গহীন। কালনী নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে প্রবল তোড়ে বাঁধটি ভেঙে ফসল ডুবে গেছে।

“অন্যান্য যতগুলো হাওর আছে, সেখানকার বাঁধ পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন ঝুঁকিতে আছে।”

দেশের খাদ্যশস্যের একটি বড় জোগান আসে হাওর থেকে। বিশাল হাওর বিস্তৃত সাত জেলা নিয়ে। এ জমির পুরোটাই এক ফসলি। হাওরের বোরো ধান রক্ষায় রয়েছে ফসল রক্ষা বাঁধ। এ বাঁধ তলিয়ে গেলে মানুষের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা থাকে না। তাই বাঁধ নিয়ে শঙ্কা বোরো ফসল না তোলা পর্যন্ত কাটে না কৃষকের।

২ এপ্রিল থেকে পাহাড়ি ঢলের কারণে সীমান্ত নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকে। এই পানি প্রবাহিত হয় ভাটির হাওরের নদ-নদীতে। প্রবল পানির চাপে হাওরের নীচু জমিগুলো তলিয়ে যায় প্রথম ধাক্কাতেই; যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাউবোর বাঁধের বাইরের এলাকা। হাওরের বাঁধ নিয়ে অনিয়ম, সময়মতো কাজ না হওয়ার অভিযোগ শুরু থেকেই করে আসছিল কৃষক।  

মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগে পাউবোর প্রকল্পভুক্ত ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার তাল হাওরের ডুবাইল বাঁধ ভেঙে ১৮৫ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে যায়। গত দুদিনে উজানের পানি একটু কমলেও বাঁধগুলো যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সেই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল পাউবো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এর মধ্যেই ডুবে গেল চাপতির হাওর।     

চাপতির হাওরপাড়ের গ্রাম কচুয়ার কৃষক মনোরঞ্জন দাস বলেন, “১৫ কেদার (৩০ শতাংশ) জমি রঙজমা (ভাড়া) নিয়ে চাষ করেছিলাম। ফসলও ভালো হয়েছিল। জমিতে নিজে এবং শ্রমিক লাগিয়ে নিয়মিত পরিচর্চা করেছি। স্বপ্ন ছিল বাম্পার ফলন দিয়ে বছরের খোরাকি সংগ্রহ করে হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর একটি খামার করব।

“কিন্তু বৃহস্পতিবার বাঁধ ভেঙে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এখন পাঁচজনের পরিবারের বছরের আহার জোগানো নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় আছি।”

একই গ্রামের সুকোমল দাস বলেন, “আমরার কোড়টা (বৈশাখীর খাড়া) রিস্কি আছিল। ইকানো আরও ভালো কইরা বান্দ বান্দা অইলে আমরার সর্বনাশ অইতো না। ইবার উগাড়ো (ধানের গোলা) একটা দানাও উঠত না। নিজে কিতা খাইমু, আর গরুরে কিতা খাবাইমু এই চিন্তায় আছি।“

তিনি জানান, জমি রঙজমা আনতে একরপ্রতি (৯০ শতাংশ) ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এবার চার একর জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেছিলেন। এই জমির পুরোটাই তলিয়ে গেছে বাঁধ ভেঙে। এখন তিনি নিঃস্ব।

একই গ্রামের কৃষক কুটিমোহন দাস বলেন, “আমি দেড় হাল (৩৬০ শতাংশে এক হাল) জমি চাষ করেছিলাম রঙজমা নিয়ে। আমার সব মিলিয়ে এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সঞ্চয়ের কিছু টাকা ও সুদে ঋণ এনে জমি চাষ করেছিলাম। এখন আমার চোখের সামনে বৈশাখীর খাড়া ভেঙে সব ফসল তলিয়ে গেছে। এখন কিভাবে চলব, ঋণ পরিশোধ করবে মাথায় কিছু আসছে না।“

একই গ্রামের কৃষক মনোরঞ্জন দাশ চাপতির হাওরে ১৫ কেয়ার বা কেদার জমি চাষ করেছিলেন। তারও সব তলিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, “ভাইরে, বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। সব জমি চোখের সামনে নিমিষেই তলিয়ে যাচ্ছে। এক ছটাক ধানও তুলতে পারি নাই। জমির মালিকের রঙজমা টাকা দিয়ে প্রতি কেয়ারে আরও তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ করে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ঋণ করে চাষ করেছিলাম। এখন খাব কী আর ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে- এই চিন্তায় আছি।”

চাপতির হাওরের পাশের তাজপুর গ্রামের কৃষক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, “আমি ১৫ কেয়ার জমির এক ছটাক ধানও খাটতাম পারছি না। সব পাইন্যে (পানি) আইয়া বাঁধ ভাইঙ্গা লইয়া গেছে।”

ক্ষুব্ধ এই কৃষক বলেন, “টেকাদি পিআইসি (হাওরে বাঁধের মেরামতে কাজ হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিইসির মাধ্যমে) আনছে যারা, তারা বৈশাখীর কোড়ে ভালো কইরা কাজ করাইছে না। এখন আমরা গরিব কৃষকরার সর্বনাশ করছে। ইবার না খাইয়া থাকত অইব।”

আরও পড়ুন:

উজানে পানি কমলেও হাওরের বাঁধগুলো ঝুঁকিতে
 

বাঁধ বাঁচিয়ে ফসল রক্ষার চেষ্টা  

কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে পানি, মূল হাওর এখনও ‘অক্ষত’  

নদীতে ঢল, ঝুঁকিতে বাঁধ, চিন্তায় হাওরের কৃষক  

হাওরে ডুবেছে ‘বোরো’, কৃষকের কপালে ভাঁজ  

হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে অনিয়মের অভিযোগ  

হাওর: কেমন হলো ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ  

নজরদারিতে হাওরের বাঁধ, স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ