সম্মান
বাঁচানোর চেষ্টায় আস্থা ভোট এড়িয়ে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন ইমরান,
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তার সেই চেষ্টা ভেস্তে গেছে।
পাকিস্তানের
ইংরেজি দৈনিক ডন লিখেছে, ইমরান এখন কী করবেন তা নিয়ে দিনভার জল্পনা কল্পনা শেষে শুক্রবার
রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে আসেন তিনি। ভাষণের শুরুতেই ইমরান বলেন, “রায়ে আমি
দুঃখ পেয়েছি, কিন্তু তা মেনে নিয়েছি।”
বৃহস্পতিবার ওই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, শনিবার স্থানীয়
সময় সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসাতে হবে। আস্থা ভোটের
নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করা যাবে না। পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে
অধিবেশন ডাকার আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়েছে।
পার্লামেন্টে
সমর্থনের যে হিসাব-নিকাশ দাঁড়িয়েছে, তাতে অনাস্থার লজ্জা নিয়ে ইমরানের প্রস্থান
অনেকটাই নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার প্রায় দেড় বছর আগেই ইমরানের দল
তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে।
সেক্ষেত্রে
বিরোধী দলগুলো জোট গড়ে তাদের একজন প্রার্থীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করতে
পারবে। ২০২৩ সালের অগাস্টে বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা
ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে।
গত
২৮ মার্চ পার্লামেন্টে এই অনাস্থা প্রস্তাব তুলেছিলেন প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম
লীগের (এন) নেতা শাহবাজ শরিফ। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নামই ঘুরেফিরে আসছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী
নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ বর্তমানে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
তাকেই প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধী জোট।
জাতির উদ্দেশে
দেওয়া ভাষণে ইমরান খান বলেছেন, তাকে সরিয়ে বিরোধী দল
থেকে সরকার গঠন হলে তা তিনি মেনে নেবেন না।
আর
‘আমদানি করা সরকার’ ঠেকাতে লড়তে প্রস্তুত জানিয়ে ইমরান রোববার এশার নামাজের পর
দেশবাসীকে ‘শান্তিপূর্ণ’ বিক্ষোভে শামিল হওয়ার ডাক দিয়েছেন।
‘বিদেশি
চক্রান্ত’ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়ে জাতি উদ্দেশে তিনি বলেন,
“আমার দেশকে বলছি, আপনারা এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে, কেউ অপনাদেরকে রক্ষা করতে
আসবে না।”
অনাস্থা প্রস্তাব পার্লামেন্টে ওঠার আগে থেকেই ইমরান খান তার
বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্র হওয়ার কথা বলে আসছিলেন। হুমকি দেওয়া একটি চিঠিও তিনি
সাংবাদিকদের দেখাবেন বলে জানিয়েছিলেন।
অবশ্য পরে তিনি বলেন, ওই চিঠিটিতে পাকিস্তানের ‘গোপন কোড’ থাকায়
সেটি প্রকাশ্যে আনা যাবে না।
ইমরানের ওই অভিযোগের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা
প্রস্তাব ওঠে। সেই প্রস্তাব পরে নাকচ করে দেন ডেপুটি স্পিকার; সুপ্রিম কোর্ট
বৃহস্পতিবার তা ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে বাতিল করে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আহ্বানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ
আলভি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জাতীয় পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করে শনিবার অধিবেশন শুরুর পাশাপাশি আস্থা
ভোটের ফয়সালা করার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের
নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ।
ক্রিকেট মাঠ থেকে রাজনীতিতে এসে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া ইমরান খান
আদালতে হারলেও ‘শেষ বল পর্যন্ত’ খেলে যাওয়ার অঙ্গীকারের কথা বলেছিলেন রায়ের পর।
আর ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ পাকিস্তানের (পিটিআই) নেতা ফয়সাল
জাবেদ খান শুক্রবারের ভাষণের আগে বলেছিলেন, তাদের নেতা একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা’
নিয়ে আসছেন। শনিবারের চ্যালেঞ্জ কীভাবে সামাল দিতে হবে, ইমরান খান সেটা ভালোই
জানেন।
শুক্রবার
রাত সাড়ে ৯টার ভাষণে ইমরান সবিস্তারে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন দেশবাসীর সামনে।
তিনি বলেন, ডেপুটি স্পিকার সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদের আলোকে
পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি এবং অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন।
“এই অনাস্থা প্রস্তাবে বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল। আমি চেয়েছিলাম
সুপ্রিম কোর্ট অন্তত এ বিষয়টিতে নজর দেবে। অন্য একটি দেশ চক্রান্ত করে পাকিস্তান
সরকারের পতন ঘটাতে চায়- এটি একটি গুরুতর অভিযোগ।”
এ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত করে দেখবে এই আশাটুকু করেছিলেন বলে
জানান ইমরান।
তিনি বলেন, “আমরা সত্য বলছি কিনা তা যাচাই করে দেখতে সুপ্রিম কোর্ট
অন্তত নথিটি দেখতে পারত কিংবা দেখার আদেশ দিতে পারত। আমি কিছুটা হতাশ হয়েছি। কারণ,
এটি অনেক বড় একটি বিষয়। অথচ এটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে কোনো আলোচনা হয়নি।”
আদালত যে ‘তাড়াহুড়োর’ মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতেও দুঃখ পেয়েছেন
বলে জানান ইমরান খান।
তিনি
বলেন, “এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? বিশ্বের কোন গণতন্ত্রে এটা করতে দেওয়া হয়? আর
ন্যায়বিচারের সবচেয়ে বড় জায়গা, বিচার বিভাগ, আমরা আশা করেছিলাম তারা আর কিছু না
হলেও একটা স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমুটো) ব্যবস্থা নেবে।”
দেশে প্রকাশ্যেই রাজনীতির ‘দর কষাকষি’ এবং আইনপ্রণেতাদের ‘বিবেক
কেনা-বেচা’ চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কোন দরে বিবেক বিক্রি হয় তা একটা শিশুও জানে।”
ইমরান খান। ছবি রয়টার্স
পাকিস্তান যেভাবে সঙ্কটে
অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার প্রতিশ্রুতি
দিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসের ইমরান খান, যার নেতৃত্বে
১৯৯২ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান।
জনগণের একাংশের কাছে তার জনপ্রিয়তা এখনও অটুট থাকলেও, সময় গড়ানোর
সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন হারাতে শুরু করেন ইমরান। মূলত মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত বেড়ে
চলায় এবং বিদেশি ঋণের বোঝা তাকে সংকটে ফেলে দেয়।
ইমরানের
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাধ পূরণ হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়ার
মধ্য দিয়ে। সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হলে তার বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু
করে।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, বর্তমান সংকটের শুরু গত অক্টোবরে, যখন
প্রধানমন্ত্রী খান পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নতুন
প্রধানের নিয়োগপত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি সামরিক বাহিনীর পছন্দ করা ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে
বাধ্য হন, কিন্তু ততক্ষণে মাঠ অনেকটা বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
বিবিসি লিখেছে, ইমরানের অবস্থানের দুর্বলতা টের পেয়ে তার জোটের
শরিকদের নিজেদের পক্ষে টানতে শুরু করে বিরোধীরা। এতে কাজও হয়। পাকিস্তানের
ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক করাচি-ভিত্তিক এমকিউএমকে নিজেদের জোটভুক্ত করে বিরোধী
দল। আর এতেই উল্টে যায় পাশার ছক।
৩৪২ আসনের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে
অন্তত ১৭৩ জন সদস্যের সমর্থন পেতে হবে। কিন্তু ইমরান বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব
তোলার আগেই ১৭৭ জন সদস্যের সমর্থন জড়ো করে ফেলে।
পার্লামেন্টে
ভোটাভুটি হলে ইমরানের উইকেট যে টিকবে না, সে বিষয়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত হয়ে
গিয়েছিলেন। আর সে কারণে আস্থা ভোটের লজ্জা এড়াতে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার কৌশল
নিয়েছিলেন। কিন্তু আদালত তা ভণ্ডুল করে দিয়েছে।
অস্থিরতা
এখন কমবে?
রয়টার্স
লিখেছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিন পাকিস্তানি রুপির বিনিময় হার ইতিহাসের সর্বনিম্ন
পর্যায়ে নেমে যায়। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বড় ধাক্কা খায়।
এ
অবস্থায় মুদ্রা বাজার সামলাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে সুদ হার ২৫০
বেসিস পয়েন্ট বাড়াতে বাধ্য হয়, যা ১৯৯৬ সালের পর সর্বোচ্চ।
তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের
পর শুক্রবার পুঁজিবাজারে দিন শুরু হয় ঊর্ধ্বমুখী সূচক নিয়ে, কারণ বিনিয়োগকারীরা ভাবতে
শুরু করেছেন, এবার হয়ত অস্থিরতা কমবে।
করাচির টপলাইন সিকিউরিটিজের
মুহাম্মদ সোহাইল রয়টার্সকে বলেন, “আদালতের আদেশের পর সাংবিধানিক সঙ্কট এবং রাজনৈতিক
অনিশ্চয়তা অনেকটা কাটবে বলে মানুষ আশা করছে। তবে অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জ, সেগুলো আগের
মতই থাকবে। নতুন একটি সরকার এসে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা সাহসী ভূমিকা নিতে পারে,
সেটাই এখন দেখার বিষয়।”
পুরনো খবর
ভাষণ দিতে আসছেন ইমরান, থাকবে ‘গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা’
‘শেষ বল’ পর্যন্ত লড়ার অঙ্গীকার ইমরান খানের
আদালতে হারলেন ইমরান, পাকিস্তানে এরপর কী?
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট পুনরুজ্জীবিত করার রায়, আস্থা ভোটে খেলতেই হবে ইমরানকে
সব সংবিধান অনুযায়ী হলে সংকট কোথায়: পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি
৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব নয়: পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন
ডেপুটি স্পিকারের আদেশ ভ্রান্ত ছিল এটি পরিষ্কার: পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি
ইমরান খানের ভাগ্য নির্ধারণী রায় আসছে
সুপ্রিম কোর্টে ইমরানের ভাগ্য নির্ধারণ ফের পেছাল
‘অবাধ্য’ ইমরান খানকে শাস্তি দিতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র: রাশিয়া
পাকিস্তানে অনাস্থা প্রস্তাব: পার্লামেন্টের কার্যবিবরণী চাইল সুপ্রিম কোর্ট
পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব বাকি বিশ্বে কতটুকু
সুপ্রিম কোর্টেই ঝুলে ইমরানের ভাগ্য
পাকিস্তান আবারও জটিলতার আবর্তে
ইমরান খানের ‘গুগলি’: অনাস্থার নাটকীয়তা শেষে ভোটের পথে পাকিস্তান