কিইভের মিত্ররা এখন নতুন করে কেন্দ্রীভূত হওয়া রুশ বাহিনীর আসন্ন হামলা মোকাবেলায় এবং সম্ভাব্য দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য ইউক্রেইনীয় বাহিনীকে প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাঠানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, জানিয়েছে নিউ্ ইয়র্ক টাইমস।
রুশ হামলার শুরুর দিকে নেটো দেশগুলো ইউক্রেইনকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বল্প পাল্লার, ট্যাংক ও বিমানবিধ্বংসী প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে জেভেলিন, এনএলডব্লিউ ও স্টিনজার ক্ষেপণাস্ত্রও ছিল। এগুলো হালকা, সহজে বহনযোগ্য, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সামান্য প্রশিক্ষণেই ব্যবহার করা সম্ভব।
কিন্তু এখন মিত্র সরকারগুলো ট্যাংক ও এস-৩০০ এর মতো ভারি অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে, এসব অস্ত্র দনবাসে আসন্ন যুদ্ধে কাজে লাগবে বলেই মনে করছে তারা।
রাশিয়ার বানানো ভূমি থেকে আকাশে লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম এস-৩০০ মূলত শত্রু বিমানকে ধরাশায়ী করতে ব্যবহৃত হয়।
“মাঠের বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে আমাদের সিদ্ধান্ত ঠিক হচ্ছে,” কূটনৈতিক আলোচনার জন্য কয়েকদিন আগেই ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে এমনটা বলেছিলেন লিথুয়ানিয়ার উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মারগিরিস আবুকেভিসিয়াস।
শনিবার যুক্তরাজ্য ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীকে ১২০টি সাঁজোয়া যান এবং নতুন জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দেওয়ার কথাও জানিয়েছে। আগের দিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউক্রেইনকে ১৩ কোটি ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। সাঁজোয়া যান ও জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তার সঙ্গে যুক্ত হল।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, কোনো পক্ষই লড়ার মানসিকতা ত্যাগ না করায় দুই বৃহৎ সেনাবাহিনীর সংঘাত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে- পশ্চিমা কর্মকর্তাদের এমন অনুমান দিন দিন আরও পোক্ত হচ্ছে। এ কারণেই ইউক্রেইনের অস্ত্রের চাহিদাও বদলাচ্ছে।
কিইভ বাহিনীর কমান্ডাররা এখন ইউক্রেইনের পূর্বে অবস্থিত বিপুল সংখ্যক সেনার সুরক্ষায় তাদের হাতে যেসব অস্ত্র আছে, তার চেয়ে ভালো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও দূরপাল্লার অস্ত্র চাইছেন। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এখন পর্যন্ত ইউক্রেইনকে এমন কোনো অস্ত্র দিতে রাজি হয়নি, যা দিয়ে রাশিয়ার ওপর ব্যাপক আঘাত হানা সম্ভব। অনেক সমর বিশ্লেষকই বলছেন, রুশ সামরিক বিমান ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি মস্কোর নতুন আক্রমণ মোকাবেলায় ইউক্রেইনের সক্ষমতা বাড়াতে পারে।
কয়েকদিন আগে জো বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছিল, তারা দনবাসে ইউক্রেইনীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষা জোরদারে সেখানে সোভিয়েত আমলে নির্মিত ট্যাংক পাঠাতে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে কাজ করছে।
ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বারবারই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের কাছে ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান চেয়ে যাচ্ছেন।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় ওয়ারশ প্যাক্টে থাকা দেশগুলোতে সোভিয়েতের যেসব অস্ত্র মোতায়েন করা ছিল, ইউক্রেইনের বাহিনী সেগুলো চালাতে বেশি পারদর্শী।
পূর্ব ইউরোপের নেটো সদস্য দেশগুলোর কাছে এ ধরনের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র এখনও আছে; দেশগুলো কিইভকে সেগুলো দিতেও চাইছে, তবে তার বদলে তাদের দরকার অত্যাধুনিক বিকল্প অস্ত্রশস্ত্র।
স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার জানান, তার দেশ ইউক্রেইনকে এস-৩০০ দিয়েছে; এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র স্লোভাকিয়ায় তাদের প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর ঘোষণা দেয়।
স্লোভাকিয়ার ওই এস-৩০০ ইউক্রেইন এরই মধ্যে ইউক্রেইনে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করেছে কিনা, তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি।
ইউক্রেইনীয়দের কাছেও একই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে, এটি কী করে চালাতে হয় তা তারা জানে। এস-৩০০ একসঙ্গে একাধিক রুশ বিমানের হামলা মোকাবেলায় বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করা হয়।
“এটা খুবই নির্ভুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা,” বলেছেন ইউরোপের সাবেক শীর্ষ সেনা কমান্ডার অবরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল বেন হজেস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউরোপের আরেক কূটনীতিক শুক্রবার জানান, ইউক্রেইনে এখন কী ধরনের অস্ত্র পাঠানো হবে, তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
যুদ্ধ কয়েক মাস এমনকী বছরব্যাপীও চলতে পারে এ ভাবনা থেকে মিত্র দেশগুলোর যুদ্ধ পরিকল্পনাকারীরা এখন নিকটতম সময়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেইনের কী কী প্রয়োজন হতে পারে তা পর্যালোচনা করে দেখছেন, বলেছেন তিনি।
এর মধ্যেও জটিলতা আছে। পশ্চিমাদের কাছে যেসব অস্ত্র আছে, তার অনেকগুলো চালাতে যে প্রশিক্ষণ দরকার, তা স্বল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেইনীয় বাহিনীকে দেওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
ইউক্রেইনের বাহিনীর কাছে এখন যেসব অস্ত্র আছে, সেগুলো চালাতে তারা সবচেয়ে বেশি পারদর্শী এবং এগুলো ব্যবহার করে তারা সফলও হচ্ছে। এসব অস্ত্রের পাশাপাশি এখন সেসব অস্ত্র পাঠানোর ঝোঁকও বাড়ছে, যেগুলোর ব্যবহার দ্রুত শেখানো সম্ভব।
প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও জোরদার করছে মিত্র দেশগুলো। ইউরোপের কর্মকর্তারা এখন বলছেন, কয়েকদিনের বদলে কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ লাগে এমন অস্ত্র যদি যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি বদলে দেয়, তাহলে সেগুলো পাঠানোই বেশ দরকার।
ইউক্রেইন যুদ্ধে সামনের কয়েকটি সপ্তাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইউরোপের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, পুতিন সম্ভবত ৯ মে’র আগেই যুদ্ধে সফলতা অর্জনের চেষ্টা করছেন; সেদিন তার ‘বিজয দিবসের’ ভাষণ দেওয়ার দিন ঠিক করা হয়েছে।
রাশিয়া প্রতিবছর ৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় উদ্যাপন করে।
ইউক্রেইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক লেফটেনেন্ট আলেক্সান্ডার ভিন্ডামান বলেছেন, ইউক্রেইনীয় বাহিনীর এখন বেশি বেশি যুদ্ধবিমান দরকার।
ইউক্রেইনের বিমানবাহিনীর প্রায় ৭০ শতাংশ শক্তি এখনও অক্ষুণ্ন, কিন্তু যুদ্ধে বিমান হারালে সেগুলোর বদলে অন্য বিমান পাওয়া কষ্টকর হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে কিইভের সামরিক কমান্ড ওই বিমানগুলো ব্যবহারে ইতস্তত করছে, ভাষ্য তার।
এর বাইরে ইউক্রেইনের আরও গোলাবারুদ ও কামানও দরকার; এমনকী ছোট, মাঝারি-পাল্লার ড্রোনও যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বলছেন ভিন্ডামান।
“রাশিয়ানরা আকাশ শক্তিতে এগিয়ে আছে। দূরপাল্লার কামান, স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকায়ও তারা এগিয়ে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে চাইলে আমাদের ইউক্রেইনে আরও অস্ত্র পাঠানো দরকার,” বলেছেন তিনি।