পার্লামেন্ট অর্থাৎ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের পর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই রোববার পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই) দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতার কাছ থেকে দুই রকম বক্তব্য আসে।
সদ্য সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী সোমবার জাতীয় পরিষদ থেকে একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বলে পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন এক প্রতিবেদনে জানায়।
এর কয়েক ঘণ্টা পর সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকে উদ্ধৃত করে ডন জানায়, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম জিও নিউজ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রিত্বের অবসানের পর বানি গালায় যে বাড়িতে ইমরান খান উঠেছেন, সেখানে তার সভাপতিত্বে পিটিআই নেতাদের এক বৈঠক হয়।
সেই বৈঠকের পর আলাদাভাবে সাংবাদিকদের সামনে আসেন ফাওয়াদ ও কুরেশি। ফাওয়াদের সঙ্গে ছিলেন সদ্য সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী হাম্মাদ আজহার ও সদ্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ফারুখ হাবিব।
ফাওয়াদ চৌধুরী। ছবি: রয়টার্স
ফাওয়াদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী হতে মুসলিম লিগ (নওয়াজ) নেতা শাহবাজ শরিফের মনোনয়নপত্র পার্লামেন্ট গ্রহণের প্রতিবাদে তাদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ক্ষমতা হারানো পিটিআই গণবিক্ষোভ চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতা ফাওয়াদ।
ইমরান খানও জনগণকে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছেন।
ক্ষমতা হারানোর পর প্রথম টুইটে তিনি বলেছেন, “পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন হওয়ার সংগ্রাম আজ শুরু হল, ক্ষমতা পরিবর্তনে বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। আর সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার কাজটি বরাবর জনগণই করে আসছে।”
Pakistan became an independent state in 1947; but the freedom struggle begins again today against a foreign conspiracy of regime change. It is always the people of the country who defend their sovereignty & democracy.
— Imran Khan (@ImranKhanPTI) April 10, 2022
সফল ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান ২০১৮ সালে দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ, বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
তবে কালের পর কাল সেনা শাসিত পাকিস্তানে তার ক্ষমতা আরোহনের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর আশির্বাদ ছিল বলেই মনে করা হয়। যার উপর ভর করে বড় দুই দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও মুসলিম লিগকে (নওয়াজ) হটিয়ে ক্ষমতায় বসেন তিনি।
সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের সম্পর্কের অবনতির মধ্যে বিরোধী দলগুলো জোট বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে জাতীয় পরিষদে।
সেটা আটকাতে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার মতো কৌশল ইমরান করলেও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তা আটকে দেয়। আদালতের আদেশেই শনিবার মধ্যরাতে অনাস্থা ভোটে ইমরানের বিদায় ঘণ্টা বাজে। তার আগে জাতীয় পরিষদের স্পিকার আসাদ কাইসার ও ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি পদত্যাগ করেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো সরকার প্রধান মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারলেও ইমরানের আগে আর কাউকে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়নি।
পাকিস্তান: অনেক নাটকের পর আস্থাভোটে ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খান
পাকিস্তান: অনাস্থা প্রস্তাবের বন্ধুর পথ পাড়ি
পাকিস্তান: যে দেশে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি কোনো সরকারপ্রধান
ইমরান খান: রাজনীতির খেলায় হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায়
এখন সোমবার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হবে পার্লামেন্টে, আর সেই পদের জন্য বিরোধী জোট সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফকে ঠিক করেছে। প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে শাহবাজ রোববার মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে এবং জাতীয় পরিষদের সচিবালয় তা গ্রহণও করেছে।
শাহবাজ শরিফ।
অন্যদিকে ইমরান খানের দল পিটিআই শাহবাজের মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করতে পার্লামেন্ট সচিবালয়ে আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায় বলে ডন জানিয়েছে।
ফাওয়াদ বলেন, “সভায় পুরো পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যদি শাহবাজ শরিফের মনোনয়নপত্র বাতিলে আমাদের আপত্তি গ্রহণ করা না হয়, তবে আমরা সবাই আগামীকাল (সোমবার) পদত্যাগ করব।”
দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত নওয়াজের ভাই শাহবাজের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা রয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কোটি রুপি পাচারের এক মামলায় সোমবার তার ও তার ছেলে হামজার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে।
সেই দিনে প্রধানমন্ত্রী পদে শাহবাজের আসার পথ করে দেওয়াটা ‘বড় অবিচার’ বলে মন্তব্য করেন ইমরানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ।
“এটা পাকিস্তানের জন্য আরও লজ্জাজনক এই কারণে যে বিদেশিদের দ্বারা ঠিক করা আমদানি করা সরকার বসছে। আর তার শাহবাজের মতো লোক তার প্রধান হতে যাচ্ছেন।”
ইমরান খান। ফাইল ছবি। রয়টার্স থেকে নেওয়া
ইমরান খান তাকে হটানোর পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছিলেন আগে থেকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অভিযোগের আঙুল তুললেও ওয়াশিংটন তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আস্থা ভোটে ইমরানের হারের পর পিপিপি ও মুসলিম লিগের দিকে ইঙ্গিত করে ফাওয়াদ বলেছিলেন, ‘ভালো মানুষটিকে বাসায় পাঠিয়ে’ দিয়ে ‘লুটেরারা’ এখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসছে।
এদিকে জাতীয় পরিষদে সোমবারের ভোটে প্রধানমন্ত্রী পদে পিটিআই নেতা শাহ মাহমুদ কুরেশিও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ বিষয়ে ফাওয়াদ বলেন, শাহবাজকে বিনাযুদ্ধে ছেড়ে না দিতেই তাদের এই পদক্ষেপ।
তবে পিটিআইর ভাইস চেয়ারম্যান কুরেশি সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় পরিষদ থেকে গণপদত্যাগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
“এরকম একটি কথা উঠছে বৈঠকে। কিন্তু তা চূড়ান্ত হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামীকাল দলের পার্লামেন্টারি কমিটির একটি সভা করবেন। সেই সভা হবে ১২টায়। কোনো সিদ্ধান্ত হলে ওই সভার পরই হবে।”
আরেক পিটিআই নেতা আলী মুহাম্মদ খানকে উদ্ধৃত করে জিও নিউজ জানিয়েছে, দলটির ৯৫ শতাংশ পার্লামেন্ট সদস্যই পদত্যাগের বিপক্ষে।
শাহ মাহমুদ কোরেশি। ছবি: রয়টার্স
এদিকে পিটিআইর জোটসঙ্গী দল আওয়ামী মুসলিম লিগ নেতা শেখ হারুন জানান, তারাও পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্তে একমত।
জাতীয় পরিষদে এই দলটির একজন সদস্য রয়েছে।
পাকিস্তানের ৩৪২ সদস্যের জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের আসন অর্ধেকের বেশি। ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাসের জন্য তাদের ১৭২টি ভোট যথেষ্ট হলেও তারা জোগাড় করে ১৭৪টি।
পার্লামেন্টে এখনও এককভাবে ইমরানের দল পিটিআইর সদস্য বেশি। এই দলের ১৫৫ জন রয়েছে পার্লামেন্টে। শাহবাজের দল মুসলিম লিগের সদস্য ৮৪ জন। প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর দল পিপিপির সদস্য ৫৬ জন, যে দলের নেতৃত্ব এখন দিচ্ছেন বেনজিরের ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো।
তিন বছর আগে সরকার গঠনের সময় মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), আওয়ামী মুসলিম লিগসহ কিছু স্বতন্ত্র এমপিদের সমর্থন নিয়েছিলেন ইমরান। সেই এমকিউএম বিরোধী জোটে ভিড়ে যাওয়া তার পতন ত্বরান্বিত করে।
ইমরানকে হটাতে নিজেদের দীর্ঘদিনের কোন্দল ভুলে এক হওয়া পিপিপি-মুসলিম লিগের নতুন সরকারে শাহবাজ প্রধানমন্ত্রী হলে বিলাওয়াল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন বলে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
বিরোধী জোটের আরেক কারিগর পাকিস্তান ডেমক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নেতা ফজলুর রহমান প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন বলে জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিশোধের রাজনীতি করব না: শাহবাজ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী শাহবাজ শরিফ, কে তিনি
ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে যে কৌশল নেবে বিরোধীদলগুলো