ঢাকায় জাপান দূতাবাস ২৭ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) এ বিষয়ে চিঠি পাঠায়।
এতে কোভিড ১৯ মহামারীর কারণে বাংলাদেশে পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ঠিকাদারি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকভাবে কাজ করতে না পারা এবং সংক্রমণ কমে আসার পর নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর সময় এবং ব্যয় যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি তার দেশের পরামর্শক ও ঠিকাদারদের স্বার্থ সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইআরডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বর্তমানে জাপানের অর্থায়নে দেশে ৩৩টি প্রকল্প চলমান। চুক্তি অনুযায়ী, এসব প্রকল্পে ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ করে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। এক্ষেত্রে নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগ কোম্পানিই জাপানের।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “জাপানের অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর কন্ট্রাক্ট গাইডলাইন ও শর্ত অনুযায়ী সময় এবং ব্যয় বাড়ানো নিয়ে দুপক্ষের আলোচনা করা উচিত।
“কোভিড ১৯ মহামারীর কারণে ক্ষতি কারও নিয়ন্ত্রণে ছিল না এবং কোনও ঠিকাদার বা প্রকৌশলীর ভুলে এ মহামারী আসেনি। এমন পরিস্থিতিতে মহামারীতে লকডাউন, মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ এবং উড়োজাহাজসহ যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় প্রকল্পের কাজের গতি কমে যায়।”
মহামারীর দুই বছরে শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, স্বাস্থ্যসুরক্ষায় বাড়তি ব্যয়, উপকরণের দাম ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কথাও উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে।
কার্জন হলের কাছে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলের শেষ ভায়াডাক্ট বসানো হয় ২৭ জানুয়ারি। ফাইল ফটো।
এ চিঠি পাওয়ার পর গত ৬ মার্চ চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ এবং প্রকল্প পরিচালকদের কাছে মতামত জানতে চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ইআরডি সচিব। প্রকল্পগুলোতে কোভিড এর কারণে বাড়তি কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে এবং সময় বাড়াতে হবে- সে বিষয়ে জানাতে বলেছেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকায় জাপান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
জাপানের এ আবেদনের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিঠিটা আমি এক ঝলক পড়েছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। মূল বিষয়টা অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
“জাইকা, ইআরডি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বসে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। আমাকে যদি তারা ডাকে তাহলে আমি আমার মতামত দেব।”
এখন এ নিয়ে ব্যক্তিগত মন্তব্য করবেন না বলেও জানান তিনি।
ইআরডি সচিবের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কয়েকবার দেখা করার চেষ্টা করেও সূচি পায়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
ইআরডির যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ডেস্কের যুগ্ম সচিব মো. আশরাফ আলী ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাপান অ্যাম্বেসি থেকে পাঠানো এক চিঠিতে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে জাপানের অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর নানাভাবে ক্ষতি হয়েছে দাবি করে যৌক্তিক পর্যায়ে মেয়াদ ও অর্থায়ন বাড়িয়ে এসব প্রকল্প সংশোধনের আবেদন করা হয়েছে।”
কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফাইল ফটো।
এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও প্রকল্প পরিচালকদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ইআরডির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত জাপানের সঙ্গে ২ হাজার ৭৪৩ কোটি ডলার ঋণ চুক্তির মধ্যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। আর আগামী জুনের মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার অর্থায়নে দেশটির সঙ্গে ৪৩তম ঋণ প্যাকেজের আরও একটি চুক্তি হতে পারে।
জাপানের অর্থায়নে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবার আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রাজধানীর উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইন (এমআরটি-৬) নির্মাণ প্রকল্প।
সময় ও মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লি. (ডিএমটিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাপান যে আবেদন জানিয়েছে তা আমরা বিবেচনা করে দেখছি। তবে এখনও আমরা কাউকে আর্থিক কোনও সুবিধা দেই নাই।
“আমাদের প্রতিটা প্রকল্পে চুক্তির সময় অনেক প্রভিশন লেখা থাকে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে সব কিছু কন্ট্রাক্ট বা চুক্তি শেষ হওয়ার পরেই কার্যকর হবে।”
ডিএমটিসিএল এমডি বলেন, “যে কারণটি তারা উল্লেখ করেছে সেখানে যেহেতু কারও হাত নেই, তাই দুই পক্ষ মিলে যৌক্তিকভাবে কিছু করা যেতে পারে। জাপান যে আবেদন করেছে তা আমরা চুক্তি শেষ হওয়ার পরে বিবেচনা করব। চুক্তির শেষ হওয়ার আগে নয়।”
মেট্রোরেল যাবে কমলাপুর: আরও ১৩৫৮ কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান
মেট্রো রেলের শেষ ভায়াডাক্ট বসল, যুক্ত হল উত্তরা থেকে মতিঝিল
বিদ্যুৎকেন্দ্র: বড় হচ্ছে মাতারবাড়ি বন্দর-নগর, ব্যয় বাড়ল ১৬০০০ কোটি টাকা
বর্তমানে দেশে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প জাইকার অর্থায়নে হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প যার অধীনে সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করা হবে। এতে জাপান দিচ্ছে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
আর রাজধানীতে চলমান মেট্রো রেলের আলাদা তিন প্রকল্পের জন্য মোট প্রায় এক লাখ কোটি টাকা দিচ্ছে তারা। এরমধ্যে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন পেয়ে এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে আসা উত্তরা থেকে কমলাপুর এমআরটি-৬ প্রকল্পে (প্রস্তাবিত অতিরিক্ত অর্থায়নসহ) অর্থায়ন করছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু যমুনা রেল সেতু প্রকল্পেও জাপান দিচ্ছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।”
জাপান যে বিষয়টি উত্থাপন করেছে তা যৌক্তিক মনে করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “জাপান যে প্রস্তাব দিয়েছে তা মূল্যায়ন করার জন্য সরকারিভাবে একটি পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।”