ক্যাটাগরি

বিহারে চোররা যেভাবে ৬০ ফুট দীর্ঘ সেতুটি গায়েব করে দিল

প্রকাশ্য দিবালোকে আরা খালের ওপর থাকা ওই লোহার সেতুটি গায়েব করে দেওয়ার ঘটনা ভারতজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

আস্ত সেতু কীভাবে চুরি হল, গ্রামবাসীরা কী করছিল, চোররা ধরাই বা পড়ল কীভাবে- পুলিশ, স্থানীয় সাংবাদিক ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এর বিভিন্ন অংশ জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছে বিবিসি।

যেভাবে একটি সেতু চুরি হল:

গত সপ্তাহের এক সকালে, রাজ্য সরকারের সেচ বিভাগের কয়েক কর্মকর্তাসহ চার-পাঁচজন যখন মাটি খোঁড়ার যন্ত্র, গ্যাস ব্যবহার করে লোহা কাটার যন্ত্রসহ সাসারাম শহরের কাছে অমিয়ওয়ার গ্রামে হাজির হয়, তখন গ্রামটির বাসিন্দারা বেশ খুশিই হয়েছিলেন।

তারা ভেবেছিলেন, সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের অনুরোধে কান দিয়েছে; পুরনো, পরিত্যক্ত সেতুটি সরিয়ে নিতে লোক পাঠিয়েছে।

টানা তিনদিন ওই লোকগুলো প্রতিদিন সকাল ৭টায় সেতুর কাছে হাজির হয়ে যেত, কাজ করতো সন্ধ্যা পর্যন্ত। কাটা লোহা তোলা হতো ভাড়া করা ভ্যানে, এরপর তা চলে যেত স্থানীয় এক ভাঙারি ব্যবসায়ীর কাছে।

“এটা যে চুরি হতে পারে, তা কারও সন্দেহতেই আসেনি,” বলেছেন স্থানীয় সাংবাদিক জিতেন্দ্র সিং। সেতু থেকে তার বাড়ির দূরত্ব ২০০ মিটারের মতো বলেও জানিয়েছেন তিনি।  

“প্রতিদিন সকালে আমি মর্নিং ওয়াকে যাই, গত সপ্তাহে দেখি কয়েকজন সেতুর ওইখানে কাজ করছে। গ্রামের প্রায় সবাই তাদেরকে দেখেছে,” বলেছেন জিতেন্দ্র।

সেতু গায়েব করার এই পুরো ব্যাপারটা সেচ বিভাগের খণ্ডকালীন কর্মী অরবিন্দ কুমারই তত্ত্বাবধান করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে; কেউ তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, সরকারি অনুমোদনেই কাজ হচ্ছে।

বিহার পুলিশ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে তার মধ্যে অরবিন্দও আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তা আশীষ ভারতি; সেতু চুরির এ ঘটনার তদন্তও তার নেতৃত্বেই হচ্ছে।

“সেচ বিভাগের কর্মকর্তা রাধে শ্যাম সিং, ভ্যানের মালিক এবং ভাঙারি ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা আরও অন্তত ৪ জনকে খুঁজছি,” বলেছেন ভারতি।

‘দিনেদুপুরে ডাকাতি’

আরা খালের ওপর থাকা ৬০ ফুট দীর্ঘ ও ১২ ফুট উঁচু লোহার সেতুটি বানানো হয়েছিল ১৯৭৬ সালে; তবে কাছাকছি কংক্রিটের একটি সেতু হয়ে গত ২ দশক এটি ব্যবহৃত হতো না।

“বছরের পর বছর সেতুতে থাকা কাঠগুলো আলগা হতে ও লোহায় মরিচা পড়তে থাকে। চোরেরা অল্পস্বল্প লোহা চুরি করে সামান্য কয়েক রুপির বিনিময়ে ভাঙারির দোকানে বেচে দিত বা অন্য কাজে লাগাতো। কিন্তু কয়েকদিন আগে যেভাবে সেতুটি চুরি হল, তা দিনেদুপুরে ডাকাতি,” বলেছেন শৈলেন্দ্র সিং নামের এক গ্রামবাসী।

‘ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায়’ সেতুটি ভেঙে ফেলতে গ্রামপ্রধান চুরির কয়েকদিন আগেই কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অনুরোধও জানিয়েছিলেন বলে জানান জিতেন্দ্র।

একাধিকবার তিনি গবাদি পশু এমনকী মানুষের উজান থেকে ভেসে আসা মৃতদেহকে সেতুটির নিচে আটকে যেতে দেখেছেন।  

“দুর্গন্ধ সহ্য করা যেত না,” বলেছেন তিনি। 

চোররা কীভাবে ধরা পড়লো?

চুরির শেষদিন ৫ এপ্রিল পাশের গ্রামে থাকা পবন কুমার জানতে পারেন, অমিয়ওয়ার গ্রামের মরিচা পড়া পুরনো লোহার সেতুটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

“আমি সেচ বিভাগের কর্মকর্তা রাধে শ্যাম সিংকে ফোন করলাম, তিনি না ধরলে ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তাকে ফোন করে তারা কেন নিয়ম মেনে সেতুটি সরিয়ে নেননি তা জানতে চাইলাম। নিয়ম অনুযায়ী তো কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল দরপত্র আহ্বান করা, এবং যে সবচেয়ে কম টাকায় কাজটি করতে পারবে বলে জানাবে তাদেরকে কাজটি দেওয়া,” বলেন পবন।

উত্তরে সেচ বিভাগের ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন, সেতুটি সরিয়ে ফেলার কোনো আদেশই তিনি দেননি, এবং এটি যে এরই মধ্যে সরিয়েও ফেলা হয়েছে তাও তিনি জানতেন না।

এরপরই এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হল। তারা তদন্তে নামল ও অপরাধীদের ধরতে অভিযান শুরু করল।

“আমরা একটি খনন যন্ত্র, গ্যাস দিয়ে লোহা কাটার একাধিক টর্চ ও বেশ কয়েকটি সিলিন্ডার, একটি পিকআপ ভ্যান ও ২৪৭ কেজি ধাতব লোহা জব্দ করেছি,” বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তা ভারতি।  

চোরেরা কেন ধাতব জিনিস চুরি করে?

ভারতের অনেক অংশেই চোরেরা নিয়মিতই পানির পাইপ চুরি করে এবং কাটা রাইফেল বানায় এমন অবৈধ অনেক কারখানায় বেচে দেয়।

চোরেরা প্রায়ই ম্যানহোলের ঢাকনাও নিয়ে যায়; এমনকী ট্রেনের টয়লেটে থাকা মগও বাদ যায় না। 

কয়েকবছর আগে ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যখন তাদের ট্রেনের টয়লেটগুলো আধুনিক করার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখনও কর্মকর্তারা টয়লেটের মগ আগের মতোই শেকলে আটকে রাখা হবে বলে জানিয়েছিলেন।

কেবল ভারতেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের অনেক অংশেও ধাতব জিনিস চুরি হতে দেথা যায়।

বিদ্যুতের তার, সংকেত দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত তার ও বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম চুরির ঘটনায় যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়।

ধাতব জিনিস চুরির ফলে ইউরোপজুড়ে শিল্প-কারখানা ও স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এবং জরুরি জনসেবায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটছে বলে জানিয়েছে ইউরোপোল।

সেতু চুরির আরও ঘটনা

যুক্তরাষ্ট্রে ২০১১ সালের অক্টোবরে পেনসিলভানিয়ার পশ্চিমে ছোট একটি শহরে থাকা ৫০ ফুট দীর্ঘ একটি সেতু চোরেরা গায়েব করে দিয়েছিল।

দুই বছর আগে রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের মুরমানস্কে একটি পরিত্যক্ত রেলওয়ে সেতু থেকে ৭৫ ফুট দীর্ঘ ও ৫৬ টন ওজনের একটি ধাতব কাঠামো নিয়ে চোরের ভেগে গিয়েছিল।

২০১২ সালে চেক রিপাবলিকে চোরেরা জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে একটি পথচারী সেতু চুরি করেছিল; সাইকেল চলবে এমন পথ তৈরিতে সেতুটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলেও সেসময় বলেছিল চোরের।