তবে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা আর যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী এ মামলার বিচারে না আসায় হুমায়ুন আজাদের পরিবারকে গ্রাস করেছে হতাশা।
তার ছোট ভাই ও মামলার বাদী মঞ্জুর কবির মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রায় নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। ১৮ বছর পর রায়ের দরকার কি? যিনি নিহত হয়েছেন, তিনি হামলায় আহত হওয়ার পর দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে দায়ী করেছিলেন। তাকেই যখন বাদ দেওয়া হল, তারপর তো আর কিছু থাকে না।
“সন্তুষ্টি বা অনুশোচনার জায়গা আমার নেই। বিচার বা রায় আমরা আর চাই না। আমার ভাবিরও (হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা আজাদ) কোনো আগ্রহ নেই।”
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে হামলার পর রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদ
বিজ্ঞানমনস্কতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পক্ষে লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হয়েছিলেন একুশে বইমেলা চলাকালে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে টিএসসির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীর চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন তিনি।
কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ওই বছর অগাস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। পরে ১২ অগাস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
হামলার পরদিন মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেছিলেন। আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। সেই মামলায় চার আসামির সাজা হবে কি না, তা জানা যাবে বুধবার।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুন বেলা ১০টার পর কোনো এক সময় তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। গত ২৭ মার্চ দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে তিনিই রায়ের জন্য ১৩ এপ্রিল দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন।
প্রেক্ষাপট
ভাষা বিজ্ঞানী, বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ তার লেখার কারণেই প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৪ সালে তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
স্ত্রী লতিফা কোহিনূরের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদ
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তখন বাংলাদেশের ক্ষমতায়। আর বইটির প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে জামায়াতে ইসলাম এ দেশে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।
সে সময় জামায়াতের এমপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, যিনি পরে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের বইটি নিষিদ্ধেরও দাবি তুলেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ সে সময় নানাভাবে সাম্প্রদায়িক হুমকি পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু একুশে বইমেলার বাইরে এভাবে তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করা হবে, সেটা কেউ ভাবেনি।
ওই হামলার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ইসলামি জঙ্গিরা হুমায়ুন আজাদের ওপর ওই হামলা চালিয়েছিল।
বিচারের দীর্ঘ অপেক্ষা
প্রথমে দায়ের করা হত্যা চেষ্টা মামলায় পুলিশ ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়ে বাদী মঞ্জুর কবির ২০০৯ সালের অক্টোবরে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন।
সেই আবেদনে তিনি বলেছিলেন, “পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটি প্রকাশের পর ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জামায়াত নেতা সাঈদী সংসদে বইটির সমালোচনা করেন, কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তার বিষয়ে তদন্ত করেননি। অপরাধী চক্র একটি বৃত্তি দিয়ে হুমায়ুন আজাদকে জার্মানিতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি হত্যার শিকার হন।”
হুমায়ুন আজাদ নিজেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় হামলার পেছনে মৌলবাদী সংগঠন এবং সাঈদীর জড়িত থাকার ইংগিত করেছিলেন সাংবাদিকদের কাছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ১৪ মে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে হত্যার অভিযোগ যুক্ত করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
মো. মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন ওরফে হামিম ওরফে হাসিম, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ এবং হাফিজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেলকে সেখানে আসামি করা হয়।
হুমায়ুন আজাদ হত্যায় পাঁচ জঙ্গি অভিযুক্ত
যুগ পেরোলেও বিচার পায়নি হুমায়ুন আজাদের পরিবার
হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় ১৩ এপ্রিল
তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী, ছাত্রলীগ নেতা আবু আব্বাস ভূঁইয়া, গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তফা মাহমুদ, আবদুল খালেক গবা ওরফে টাইগার, শফিক উল্লাহ ওরফে সাদ এবং ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও খালেদ সাইফুল্লাহর নাম সম্পূরক অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূইয়া জিন্নাহ ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সম্পূরক অভিযোগেপত্রের পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচার শুরুর আদেশ দেন।
হুমায়ুন আজাদ। ছেলে অনন্য আজাদের ফেইসবুক থেকে
আসামিরা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তাদের মধ্যে মিনহাজ ও আনোয়ার কারাগারে আটক রয়েছেন। নূর মোহাম্মদ শুরু থেকেই পলাতক।
সালাহউদ্দিন সালেহীন ও হাফিজ মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেও ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। সালেহীন পালিয়ে যেতে পারলেও হাফিজ মাহমুদ পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
তদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ
মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, “জার্মানি থেকে পাঠানো হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু সনদ এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, অ্যানাটমিক্যালি মৃত্যুর যথেষ্ট কারণ পাওয়া না গেলেও টর্চারের (নির্যাতনের ফলে) ফলে তার মৃত্যু ঘটেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এবং হাইপার টেনশনে তিনি মারা যান।
“জার্মানির মিউনিখ হাসপাতালের অটোপসি রির্পোট পর্যালোচানায় দেখা যায়, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির ওই তারিখে ঘটনার দিন মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি অসুস্থ ও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার পরও আরোগ্যপ্রাপ্ত না হয়ে বরং তিনি ধীরে ধীরে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৪ সালের ১২ অগাস্ট জার্মানির মিউনিখের বাসস্থানে যাওয়ার চারদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।”
সাক্ষী ছিলেন কারা
রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী বিপুল দেবনাথ জানান, এ মামলার দুই আসামি মিনহাজ ও আনোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
হুমায়ুন আজাদ। ছেলে অনন্য আজাদের ফেইসবুক থেকে
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন কবি রফিক আজাদ (বর্তমানে প্রয়াত), বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী (বর্তমানে প্রয়াত), কবি বদরুল হক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন প্রকাশনা সম্পাদক ও মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, কবি মোহন রায়হান, হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদ, ছেলে অনন্য আজাদ, আলোকচিত্র সাংবাদিক ইফতেখার উদ্দিন পাভেল, হুমায়ুন আজাদের ভাই সাজ্জাদ কবির, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সহকারী সচিব আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ছাত্র মো. আশরাফ সিদ্দিকি বিটু, জার্মান দূতাবাসের পলিটিক্যাল অ্যাডভাইজার মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক রঞ্জন কুমার দে, তদন্ত কর্মকর্তা ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ ৪১ জন।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কোভিড মহামারী, সাক্ষ্যগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে এ মামলার বিচার বিলম্বিত হয়েছে বার বার।
পাঁচজন বিচারকের হাত ঘুরে ষষ্ঠ বিচারক হিসেবে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুন এ মামলার রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছেন।