ক্যাটাগরি

লাইটম্যান সবুজ মিয়া: জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসে ফুরালো জীবন

বাবা, মা, স্ত্রী ও ১৩ মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসারে আলো এনেছিলেন লাইটম্যান সবুজ; মহামারীর ক্ষতচিহ্ন আর আর্থিক টানাপোড়েন সামলিয়ে মাসে মাসে ঢাকা থেকে বাড়িতে টাকা পাঠাতেন তিনি।

পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, ক্রমেই ফুলেফেঁপে ওঠা অনটনের দিন বুঝি এবার ফুরালো; কিন্তু সবুজ নিজেই ফুরিয়ে যাবেন-তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি পরিবারের সদস্যরা।

একটি নাটকের শুটিংয়ের সেটে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছয় দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার মারা গেছেন সবুজ।

আট মাস আগে চাচা শ্বশুর নুরুন্নবী মিয়ার সঙ্গে ঢাকায় এসে ‘লাইট গ্যালারি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে লাইটম্যান হিসেবে কাজ নেন সবুজ; প্রতিষ্ঠানটি টিভি নাটকের শুটিংয়ের আলোকসজ্জার কাজ করে।

নুরুন্নবী মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবুজের নিজের কোনো জমিজমা নেই। আগে দিনমজুরি করে, অটো চালিয়ে কিংবা দিনচুক্তিতে ধান কাটার কাজে সংসার চালাত সে। মাঝে লকডাউনে সেই আয় বন্ধ হওয়ায় সে ঢাকায় আসে।”

সবুজ মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

সবুজ মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

পেশায় ট্রলি চালক নুরুন্নবী মিয়া তার কাজের সংস্থান করে দিয়েছিলেন; তার ভাষ্যে, লাইটম্যান হিসেবে রোজ এক হাজার টাকা পেতেন সবুজ। বাড়িতে টাকাও পাঠাতেন; সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছিল।

বাবা, মা ও স্ত্রীর সঙ্গে নিজের ১৩ মাসের কন্যাকে রেখে গেছেন সবুজ; যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, কন্যাকে মানুষের মতো মানুষ করবেন।

‘লাইট গ্যালারি’-এর কর্ণধার খলিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসপাতালে যখনই সবুজের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখনই বলেছে, কাকা আমি মনে হয় বাচমু না; আমার বাচ্চাটাকে একটু দেইখা রাইখেন। ও আমার আদরের ধন।”

খলিলের প্রতিষ্ঠানে মোট ৩৫ জনের কর্মী কাজ করেন; সবুজ মূলত শুটিংয়ের লাইটিংয়ের কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানটির উত্তরার কার্যালয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।

খলিলের ভাষ্যে, “খুব অল্প দিনের ভেতরে সবার সঙ্গে সবুজের ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। ছেলেটা খুব মিশুক ছিল; সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। এভাবে তাকে হারিয়ে ফেলব-ভাবতেও পারছি না। তার মৃত্যুর খবরে সব কর্মীরা কাজ বন্ধ করে হাসপাতালে ‍ছুটে এসেছে।”

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। ফাইল ছবি

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। ফাইল ছবি

যে নাটকের শুটিংয়ের সেটে সবুজ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন সেই নাটকের পরিচালনার দায়িত্বে আছেন চয়নিকা চৌধুরী; সবুজের মৃত্যুর পর মঙ্গলবার বিকালে মিরপুর ডিওএইচএসের সেই শুটিং হাউজে পরিদর্শন করে এসেছে পল্লবী থানার একটি দল।

পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সবুজের মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশ খোঁজ-খবর নেয়, হাসপাতালেও যায়। তবে কেউ বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ না করায় মামলা হয়নি।

সবুজের মরদেহ বর্তমানে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আছে; আইনি আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ নিয়ে গাইবান্ধার পথে রওনা করবেন সবুজের বাবা, মাসহ পরিবারের সদস্যরা।

ছেলের শোকে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন সবুজের মা; একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা তার বাবা।

খলিল জানান, সবুজের পরিবারকে চয়নিকা চৌধুরী ৫০ হাজার টাকা সহায়তা করেছেন; তারাও তার পরিবারের পাশে থাকতে চান।

দুর্ঘটনা যেভাবে

গত বুধবার মিরপুর ডিওএইচএসের একটি শুটিং হাউজে চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রথম প্রেম’ নামে একটি টিভি নাটকের শুটিং ছিল। শুটিংয়ের প্রস্তুতির মধ্যে স্কিমার (রোদের যাত্রা কমানোর জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) লাগাতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান খলিল।

তার ভাষ্যে, “স্কিমারটি স্ট্যান্ডে লাগানোর পর বাতাসের তোড়ে বারান্দার পাশে বৈদ্যুতিক তারে ওপর গিয়ে পড়েছে। পরে পুরো স্ট্যান্ডে আগুন লেগে গেলে সেটি তার শরীরে লাগে।”

আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, সাদিয়া ইসলাম মৌসহ আরও অনেকে সেই নাটকের অভিনয়শিল্পী ছিলেন।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর সবুজকে প্রথমে কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান চয়নিকা চৌধুরী।

সোমবার সবুজের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেওয়া হয়েছিল; এর মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আর ফিরলেন না তিনি।

তারকাদের শোক

অল্প সময়ের মধ্যে নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের মাঝে পরিচিতি পাওয়া সবুজের মৃত্যুতে অনেকেই শোক জানিয়েছেন ফেইসবুকে।

মঙ্গলবার ‘মাশরাফি জুনিয়র’ নাটকের শুটিংয়ের আগে সবুজের আত্মার শান্তি কামনা করে এক মিনিট নিরবতা পালন করেছেন নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা।

এক ফেইসবুক পোস্টে শোক প্রকাশ করে ‍চয়নিকা লিখেছেন, “পরপারে ভালো থেকো সবুজ, এই কয়দিন অনেক কষ্ট পেয়েছ। তুমি থাকবে আমার অন্তরে, চোখের ওপর।”

অভিনেতা রাশেদ মামুন অপু লেখেন, “আমাদের আলোকিত করতে গিয়ে নিজেই অন্ধকারে চলে গেলেন সবুজ। আমাদের লাইটের সবুজ।”

অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর লিখেছেন, “সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তাকে বেহেস্তবাসী করবেন।”

অভিনেতা সুজাত শিমুল লিখেন, “আহারে জীবন। আল্লাহ তোমাকে ওপারে ভালো রাখবেন নিশ্চয়ই। তোমার আত্মার শান্তি কামনা করছি ভাই।”