ক্যাটাগরি

‘স্বীকারোক্তি আদায়ের’ নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন ছাত্রলীগের আব্বাস

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় হয়েছে বুধবার, কিন্তু নিজের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিচার পাওয়ার কোনো পথ জানা নেই আব্বাসের।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা হলে পর দিন এর প্রতিবাদে মিছিল করে ছাত্রলীগ। সেখান থেকেই আটক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পর্যায়ের নেতা আব্বাসকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন পরিবারের বড় ছেলে আব্বাস। চার বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন, তবে আব্বাস যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, তখনই তার বাবা মারা যান।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পড়তে এসে ওই একটি ঘটনাই তার জীবনকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেই গল্প বলতে গিয়ে ভারী হয়ে আসে আব্বাসের কণ্ঠ।

“স্যারের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছিল, আমি ছিলাম এনেক্স ভবনের সামনে। এনেক্স ভবনের সামনে থেকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে ঘুরে গেলাম। দেলোয়ার ভাই সাথে ছিল, আমাকে সেই জায়গা থেকে অ্যারেস্ট করছে।

“আমি তখনও জানি না, হুমায়ুন আজাদ স্যারের মামলায় আমাকে অ্যারেস্ট করবে। আমি ভাবছি পিকেটার হিসাবে অ্যারেস্ট করছে।”

আব্বাস বলেন, “রমনা থানায় নিয়ে গেল। চোখ বেঁধে ফেলল। মনে হল, আমাকে একটা বাক্সের মধ্যে ঢুকায় ফেলল। তখন লাঠি দিয়ে মাইর শুরু হইল। আমি বললাম, আমার কী অপরাধ, আমাকে মারতেছেন কেন?

“থানায় নেওয়ার পর থাইকাই সমানে লাঠি দিয়া পিডাইতাছে। বলতেছে, তোকে স্বীকার করতে হবে, হুমায়ুন আজাদ স্যারকে তুই হামলা করছস।”

সেই সময় ক্যাম্পাস থেকে পিকেটার হিসাবে পুলিশ ছাত্রদের আটক করলে বেশিরভাগকেই সন্ধ্যার সময় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু আব্বাসকে তারা ছাড়েনি।

“আমি বুঝতে পারতেছিলাম না, আমি কেন হুমায়ুন আজাদ স্যারকে হামলা করব? আমাকে কেন এই মামলায় অ্যারেস্ট করবে? হুমায়ুন আজাদ স্যারের সাথে তো আমাদের আদর্শিক কোনো বিরোধ নাই, আমার সংগঠনের আদর্শিক কোনো বিরোধ নেই। এরপরও তারা আমাকে নির্যাতন করেই যাচ্ছিল।”

মুক্তি পাওয়ার পর সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছাত্রলীগ নেতা আবু আব্বাস ভূঁইয়াকে

মুক্তি পাওয়ার পর সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছাত্রলীগ নেতা আবু আব্বাস ভূঁইয়াকে

সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আব্বাস বলেন, “আর কী বলমু বলেন, বলতে গেলে আমার কান্না আইসা পড়ে। তারা বলে, আমাকে স্বীকার করতেই হবে।

“আমার চোখ বাঁধা, আর হাতও পিছমোড়া করে বানছে। তখন আমি কানতেছি, আর আমাকে পিডাইতেই আছে, আর বলতেছে, তোরে স্বীকার করতে হবে।

“তারপর, একটু পরে আমারে ঝুলায় দিল। মানে পা উপরে দিয়ে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলায় দিল। ঝুলায় দিয়ে মারতেছে আর বলতেছে, স্বীকার করতেই হবে। আমি কানতেছি আর চিল্লাইতেছি।”

আব্বাস প্রশ্ন রাখেন, “আপনাকে যদি অকারণে কোনো মামলায় ধরে, আপনি কী বলবেন?… আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলায় রাখছে আর মারতেছে। আমি চিল্লায়া চিল্লায়া বলতেছিলাম, আমাকে মাফ করেন, মাফ করেন, আমাকে মারতেছেন কেন?  তারা বলে, না, তোকে স্বীকারোক্তি দিতে অইব। এক পর্যায়ে আমি প্রায় অজ্ঞান।

“এরপর আমাকে নামাইল। আমি ভাবলাম, এবার বাঁচলাম। নিচে বসায়া তারা আমার আঙুলে লাঠি দিয়ে বাড়ি মারা শুরু করল। আমার চোখ তখনও বাঁধা। মনে হল আঙুল দুই-তিনটা ভাঙছে। বলতেছে, তোর স্বীকার করতেই হবে, তুই আজাদ স্যাররে ইয়ে করছস, কালকে কোর্টে যামু, রিমান্ড শুনানি। তখন তোর স্বীকার করতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে।”

“আমি বলি, এটা কী কন! আমি উনারে কেন হামলা করব। আমারে বলে, অমুক বলছে, আওয়ামী লীগ নেতারা তোর কথা বলছে, তোরে স্বীকার করতেই অইব। তখন রিমান্ডে আনল, রিমান্ডে আইনা এভাবে চলল, তিন চার দিন চলল। আমি স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হই নাই “

রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন

আব্বাসকে ১ মার্চ হুমায়ুন আজাদ হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয় রমনা থানা পুলিশ।

তিনি জানান, রিমান্ড শুনানির জন্য তাকে সে সময় আদালতেও তোলা হয়নি, কোর্ট হাজতে রেখেই শুনানি হয়েছে। কিন্তু কাগজে কোর্টে তোলার কথা বলা হয়েছে। এরপর রিমান্ডে নিয়ে শুরু হয়েছে ফের নির্যাতন।

“আমি রিমান্ড থাকা অবস্থায় ভাত খাওয়া ছাইড়া দিছিলাম। কিছু খাইতাম না। আমার একটা শক্তি ছিল, আমি তো কিছুই করিনি, কিছুই জানি না। তারা তখন আমারে খাওয়াইতে আসছে, এটা করতেছে সেটা করতেছে, আমি খাই না। আমি বলি, আমাকে মারেন, মাইরা ফালান। এই ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, আমি স্বীকার করুম না।

“আমি তাদের বলছি, আমি ছাত্রলীগ করি, মিছিল করছি, আপনি আমাকে এই অপরাধে মামলা দিতে পারেন। হুমায়ুন আজাদের বিষয়ে আমারে হুদাই কেন জড়াইতেছেন।”

এর মধ্যেই মামলার তদন্তভার পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।  নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হাজতে গিয়ে আব্বাসের সাথে কথা বলে যান। ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা পাননি জানিয়ে মারধরের মাত্রা দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেন।

আব্বাস বলেন, “সিআইডির ওই অফিসার আমারে বলে, ‘আপনাকে থানা পুলিশ এভাবে মারল কেন সেইটাও তো একটা রহস্য’। বাম হাতের আঙুল ভাঙা তিনটা। সবচেয়ে বড় নির্যাতনটা হইছে, উল্টায়া যখন পায়ের তলায় বাড়ি মারে তখন। তখনতো এক্কেবারে ব্রেইনে গিয়া লাগে। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য, একটা মানুষকে যা খুশি মারা যায় আর কী…।”

আব্বাস থেকে ‘বোমা আব্বাস’

ওই যাত্রায় ১২দিন পর জামিনে ছাড়া পান ছাত্রলীগ নেতা আব্বাস। পরে তাকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি।

সেখানে আসামি করা হয় পাঁচ জঙ্গিকে, যাদের মধ্যে একজন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। বাকি চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বুধবারের রায়ে।  

আব্বাস বলেন, “মুক্তি দিলেও ততদিনে আমাকে সন্ত্রাসী হিসেবে গণমাধ্যমের কাছে চিহ্নিত করে দিছে পুলিশ। নাম বিকৃত করে ‘বোমা আব্বাস’ হিসেবে প্রচার করছে তারা।”

মুক্তির পর সেই নাম তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে বার বার। ক্যাম্পাসে বোমা ফাটলেই পুলিশ তার নামে মামলা দিত। এভাবে অন্তত এক ডজন মামলার আসামি বনে যান তিনি। মামলার আতঙ্ক নিয়েই তখন তার দিন পার করতে হত।

পরের বছর ভ্যালেন্টাইন ডেতে টিএসসিতে বোমা হামলার ঘটনায় আবারও আব্বাসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই যাত্রায় তাকে চার মাস কারাগারে থাকতে হয়।

আব্বাস বলেন, “আমারে বোমা আব্বাস বানায় দিল। এর আগে আমার নামে কোনো মামলা ছিল না। এখনও কিন্তু আমারে মানুষজন মনে করে, আমি সন্ত্রাসী। তবে আমার মামলা সবগুলো গতানুগতিক ধারায় শেষ হইছে। বিএনপির আমলে কিছু, ওয়ান ইলেভেনের সময় সব মামলা থেকে অব্যাহতি পাই আমি।”

মামলা চালাতে গিয়ে সংসার শেষ

ডজনখানেক মামলা চালাতে গিয়ে সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছিল বলে জানান আব্বাস।

“আমার মা সম্পত্তি বিক্রি করে এতোগুলো মামলা চালাইছে। আমি জেলে যাইতাম, মা আমার জেলখানায় আসত। মধুর ক্যান্টিনে যাইত। গ্রামের মহিলা।

মুক্তি পাওয়ার পর সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছাত্রলীগ নেতা আবু আব্বাস ভূঁইয়াকে

মুক্তি পাওয়ার পর সংবর্ধনা দেওয়া হয় ছাত্রলীগ নেতা আবু আব্বাস ভূঁইয়াকে

“আমার মা এখন নাই, কিন্তু তার কথা বারবার মনে পড়ে। একটা ফ্যামিলিকে ধ্বংস করার জন্য যা করা দরকার আমার সঙ্গে তার সবকিছুই হয়েছে।”

এখন ছোট-খাট ব্যবসা করে দিন কাটছে আব্বাসের। বাঁ হাতের তিনটা আঙুল ভাঙা, শরীরের নানা জায়গায় এখনও ব্যথা করে। দলেরও কোনো পদেও নেই। সর্বশেষ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাও কয়েক বছর হল।

‘দায় চাপাতেই’ নির্যাতন

হুমায়ুন আজাদকে হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হলেও কখনও তাকে সামনাসামনি দেখেননি বলে জানান আব্বাস।

তিনি বলেন, “আমি কিন্তু এর আগে স্যারকে চাক্ষুষ দেখি নাই কোনোদিন। আমি তার নারী বইটা পড়ছি, বিভিন্ন বই পড়ছি। তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান।”

তাকে গ্রেপ্তারের পর তখনকার পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, ‍হুমায়ুন আজাদকে হত্যা চেষ্টা মামলার একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ আসামিকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আব্বাস বলেন, “এমন কি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও তখন ওই হামলার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছিলেন। আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের মধ্য দিয়ে পুলিশ সেইসব বক্তব্যকেই প্রমাণ করতে চেয়েছিল।”

গ্রেপ্তারের দিন ঢাকার মুগদা এলাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একটি সমাবেশ ছিল বলে জানান আব্বাস।

“সেই সমাবেশে খালেদা জিয়া বললেন, আওয়ামী লীগ এই হামলা চালাইছে, হরতাল সফল করার জন্য। আমাকে অ্যারেস্ট করার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বলছিল যে, ‘ক্লু পাওয়া গেছে’। তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন বলে ফেললে তো কোনো তদন্ত থাকে না।”

বিচার পাওয়ার আশায় আদালতে গিয়েছিলেন আব্বাস। বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রমনা থানার তৎকালীন ওসি মাহাবুবুর রহমান, এসআই রেজাউলসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

আসামি পক্ষের আবেদনে উচ্চ আদালতের আদেশে সেই মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে।