বৃহস্পতিবার ভোরের সোনালি আভায় ছায়ানটের আয়োজনে রমনা বটমূলে বঙ্গাব্দ ১৪২৯ কে বরণ করে নিয়েছে বাঙালি; যে জায়গাটি ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে বাংলা বর্ষবরণ আয়োজনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
পুরুষদের কেউ কেউ পাঞ্জাবি-পাজামা আর নারীদের অনেকে লাল-সাদা শাড়ির সঙ্গে খোঁপায় ফুল জড়িয়ে হাজির হয়েছিলেন রমনায়; আলপনায় কপোল রাঙিয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রাণের মেলায় এসেছিল শিশুরাও।
দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বটমূলে ঘটে প্রাণের সঞ্চার; কবিগুরুর ‘নব আনন্দে জাগো’ বাণীকে এবারের আয়োজনের প্রতিপাদ্য করেছিল ছায়ানট।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা বলেন, “এবার আমরা নব আনন্দে জাগবার আহ্বান জানাচ্ছি। দুই বছর কারাবন্দির মত একটা অবস্থা ছিল, সেই অবস্থা থেকে একটা স্বস্তির অবস্থায় এসেছি।
“নতুন করে আবার বটমূলে ফিরতে পেরেছি। সবাইকে নিয়ে আজকে যে প্রাণের মেলা হয়েছে, আমি মনে করি, মানুষের মনের ভেতরের আনন্দের কথা সঞ্চারিত হয়েছে।”
লাইসা আহমেদ লিসার ভাষায়, কোনো বাধায় বাঙালির প্রাণের উচ্ছ্বাস দমানো যায় না; মহামারীর শঙ্কা কাটিয়ে, সাম্প্রদায়িকার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নেমেছে বটমূলে।
“এটা আমরা জানি, এরকম জোয়ার হবে। হয়ত নানান ভয় থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস, উদ্যম দমানো যায় না। এটাই আমাদের বিশ্বাস ছিল।”
বৈশাখের প্রথম সকালে বৃহস্পতিবার রমনা বটমূলে গানে গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানান ছায়ানটের শিল্পীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
স্বাস্থ্যগত কারণে এবারের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন না ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সনজীদা খাতুন; তার কণ্ঠে ধারণ করা রবীন্দ্রসংগীত ‘নব আনন্দে জাগো’ এর অংশবিশেষ বাজানো হয় মঞ্চে।
ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, “বাঙালির জীবনে নববর্ষের আয়োজন একমাত্র অসাম্প্রদায়িক আয়োজন, সকল ধর্মের মানুষের বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করা- এই সত্যটি বাঙালির জীবনে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।”
তিনি বলেন, “হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে ধারণ করে মানবিক সমাজ গঠনে আমাদের প্রাণিত করে বাংলা নববর্ষ। এই প্রত্যয় অর্জনে অর্ধ শতাধিক বছর ধরে সুর ও বাণীর আবহে রমনা বটমূলে আয়োজিত হচ্ছে বাঙালির মিলন মেলা।
“অতিমারীর কারণে গত দুটি বছর আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় এবং স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে আমরা গৃহবন্দি ছিলাম। দুঃসময় পেরিয়ে এবার নব আনন্দে জাগ্রত হওয়ার আয়োজন করেছে ছায়ানট।”
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে এসেছিলেন ছায়ানটের এ আয়োজনে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের রথী মহারথীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ যোগ দিয়েছে এ উৎসবে।
ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রুবাইয়াৎ হোসেন বললেন, এর আগে দুইবার বটমূলের বৈশাখী আয়োজনে আসার ইচ্ছা থাকলেও পারেননি; এবারই প্রথমবার এসেছেন।
“আমি ভেবেছিলাম, এবার হয়তো তেমন জনসমাগম হবে না। কিন্তু এসে ধারণা বদলে গেছে। পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। একসঙ্গে গান শুনলাম; খুব ভালো লেগেছে পুরো আয়োজন।”
লাল পারের সাদা শাড়ি পরে রমনায় এসেছিল দেড় বছরের রুপন্তি; সঙ্গে তার বাবা শফিক মাহমুদ ও মা তাসনিম মাহমুদ।
মিরপুরের বাসিন্দা শফিক মাহমুদ বললেন, “বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে মেয়েকে নিয়ে এসেছি; গতবারও আসার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এবার আর মিস করিনি।”
বৈশাখের প্রথম সকালে বৃহস্পতিবার রমনা বটমূলে গানে গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানান ছায়ানটের শিল্পীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
রমনার খোলা হাওয়ার ভোরে রাগ রামকেলি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানান ছায়ানটের শিল্পীরা। পরে সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রসংগীত ‘মন, জাগো মঙ্গল লোকে’।
পৌনে ৯টা পর্যন্ত ছায়ানটের ৮৫ শিল্পীর অংশগ্রহণে মোট ৩৭টি গান-আবৃত্তি পরিবেশিত হয়; শোনানো হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, দিজেন্দ্রলাল রায়, লালন সাঁইসহ আরও অনেকের গান।
লাইসা আহমেদ লিসা ‘গাও বীণা, বীণা গাও রে’, খায়রুল আনাম শাকিল ‘আনো আনো অমৃত বারি’, শাহীন সামাদ ‘অন্তরে তুমি আছ চিরদিন’ গেয়ে শোনান।
রাগ তোড়ি কণ্ঠে তোলেন বিটু কুমার শীল, রাগ ভৈরবী পরিবেশন করেন অভিজিৎ কুণ্ডু। আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ডালিয়া আহমেদসহ অনেকে।
ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ দুটো আয়োজন এখন বাঙালির বর্ষবরণের অত্যাবশ্যক অনুসঙ্গ।