মাংসের ব্যয়বহুল খরচ বাঁচিয়ে প্রোটিনের সুলভ মূল্যের উৎস মুরগির ডিমের বাড়তি দাম ভোক্তাদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠছে বলে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়।
খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ইস্টার সানডে এবং ইহুদিদের বার্ষিক পরবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে ‘ইস্টার এগ’ এবং উৎসবের বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ডিমের ব্যববহার বেড়ে যাওয়ায় চাহিদাও লাফিয়ে বেড়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের পর বার্ড ফ্লুর সবচেয়ে বড় সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক খামারগুলোর এক কোটি ৯০ লাখ ডিম পাড়া মুরগি কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে সংবাদ সংস্থটি নিজেদের হিসাব তুলে ধরে জানায়, এ সংখ্যা দেশটির মোট মুরগির ৬ শতাংশ।
এছাড়া বার্ড ফ্লুর তীব্র প্রকোপের কারণে প্রায় ৮ শতাংশ মুরগি নিধন করেছে ফ্রান্স।
বার্ড ফ্লু বা এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সাধারণত বুনো পাখির মাধ্যমেই ছড়ায়। কোনো খামারে সংক্রমণ দেখা গেলে রোগ নিয়ন্ত্রণে পুরো খামারের সব মুরগি মেরে ফেলা হয়।
ভয়ানক এই ভাইরাস এবং ইউক্রেইন যুদ্ধই ডিম সরবরাহকারীদের জন্য সম্প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠলেও লোকবল সংকট এবং প্রাণি খাদ্যে ব্যবহার করা শস্য এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণেও তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
ছবি: রয়টার্স
প্রতিবেদনে বলা হয়, ময়দাসহ অন্যান্য উপকরণের বাড়তি দামের কারণে টালমাটাল অবস্থায় পড়া খাবারে কোম্পানি এবং বেকারিগুলোর লাভের গুড় খেয়ে ফেলছে নতুন করে বেড়ে যাওয়া ডিমের দাম।
জাতিসংঘ খাদ্য সংস্থা বলছে গমসহ অন্যান্য শস্যের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর পর খাদ্যশস্যের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মার্চে পুরো বিশ্বে খাবারের দাম প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড হয়েছে।
আক্রান্ত খামারগুলোতে আবারও কার্যক্রম শুরু করতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে জানিয়ে মুরগির খামারিরা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে ডিমের দাম চড়া থাকতে পারে।
সংক্রমণের কারণে প্রক্রিয়াকরণ করা ডিমের গুঁড়ো কিংবা তরলীকৃত পণ্য তৈরিতেও কারখানাগুলোতে কাজের সমস্যা হচ্ছে। কেক এবং প্যানকেকের মিশ্রণসহ ডিমের স্যান্ডউইচে এসব ব্যবহার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রোজ একর ফার্মস এর প্রধান নির্বাহী মার্কাস রাস্ট বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কারখানাগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করছে।”
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের লোয়া রাজ্যে কোম্পানিটির একটি খামারে প্রায় ১৫ লাখ ডিম পাড়া মুরগি বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এর ফলে একটি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে।
ছবি: রয়টার্স
সরবরাহের ঘাটতি সবখানে
বার্ড ফ্লুর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ডিম উৎপাদনকারী রাজ্য লোয়ায় দুটি খামারের সব মুরগি নিধন করা হয়েছে, যার প্রত্যেকটিতে ৫০ লাখের বেশি মুরগি ছিল।
বুধবার নেবরাস্কা জানিয়েছে, আক্রান্ত হওয়া এ রাজ্যের ১৭ লাখের বেশি মুরগি মেরে ফেলতে হবে।
এমন বিশাল আকারের পোল্ট্রিগুলো আক্রান্ত হওয়ার কারণে বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য শিল্প খাত। প্রতিবেদনে বলা হয়, তুলনা বিচারে ইউরোপের খামারগুলো এর চেয়ে ছোট।
গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্টের পাইকারি বাজারে বড় আকারের ডিমের দাম প্রতি ডজন ৩ ডলার পর্যন্ত উঠে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে যায়।
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান আর্নার ব্যারি জানিয়েছে, সরাসরি লেনেদেনের বাজারগুলোতে ডিমের দাম এক বছর আগের চেয়ে প্রায় ২০০ শতাংশ বেড়েছে।
এর আগে কোভিড মহামারীর শুরুর দিকে ডিমের দাম সর্বোচ্চ ৩ ডলার ৯ সেন্ট পর্যন্ত হয়েছিল। অবশ্য আর্নার ব্যারি জানিয়েছে, প্রক্রিয়াকরণ করা তরল ডিমসহ ডিমজাত পণ্য এখন রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে।
ছবি: রয়টার্স
ফরাসি খামার ফ্রান্সএগ্রিমার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ফ্রান্সের পাইকারি বাজারে ডিমের দাম গত বছরের চেয়ে ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যে কারণে ডিম দিয়ে তৈরি খাদ্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে।
ফরাসি কৃষি-খাদ্য কোম্পানি এভরিল এর প্রধান নির্বাহী জ্যাঁ-ফিলিপ পুইগ বলেন, “ডিমের দাম বেড়ে গেলে মেয়নেইজ উৎপাদনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। আপনাকে সুপারমার্কেটে গিয়ে বাড়তি দাম মেনে নেওয়ার জন্য তাদের বোঝাতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের সময় সরবরাহ বাড়ানোর জন্য ফ্রান্স, ইতালি এবং স্পেইনের কাছ থেকে ডিম আমদানি করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার ইউরোপেও সংক্রমণের কারণে আমদানি করার উপায় খুব বেশি কাজে দেবে না।
আর্নার ব্যারি’র ডিমের বাজারের প্রতিবেদক কারিন রিসপলি বলেন, “সার্বিক ঘাটতি বিবেচনায় এটা একটা বৈশ্বিক বিষয় হয়ে উঠবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবাই এখন সরবরাহের ঘাটতির মধ্যে রয়েছেন।”
চাহিদা বদলে দিচ্ছে ইউক্রেইন যুদ্ধ
কেবল রোগ সংক্রমণ নয় যুদ্ধের কারণেও মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতাদের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান ফারজানা ট্রেডিংয়ের ডিম আমদানিকারক সন্তোষ কুমার জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে ইউক্রেইন থেকে আমিরাতে ডিমের কোনো চালান আসার খবর পাচ্ছেন না।
তিনি জানান, ইউক্রেইনের পরিবর্তে তারা এখন তুরস্ক থেকে ডিম আমদানি করছেন।
ইউক্রেইন সরকারের পরিসংখ্যান সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইউক্রেইনে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৪১০ কোটি। এর আগের বছর উৎপাদন হয় ১ হাজার ৬২০ কোটি ডিম।
ছবি: রয়টার্স
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় ডিম উৎপাদনকারী দেশ ফ্রান্সের শিল্প গ্রুপ সিএনপিও জানায়, ডিম উৎপাদনে সেবছর তাদের ছাড়িয়ে গেছে ইউক্রেইন। ফ্রান্সের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৫৫৭০ কোটি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান ডিম সরবরাহকারী দেশ হয়ে ওঠে ইউক্রেইন। যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে তাদের অর্ধেকের বেশি ডিম আমদানি করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
সিএনপিও’র ভাইস প্রেসিডেন্ট লোয়িক কোলোম্বেল জানান, যুদ্ধের আগে ইউক্রেইন থেকে ডিম আমদানি করা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইউরোপের অন্য দেশ থেকে ডিম কেনার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, “ফ্রান্সে বার্ড ফ্লুর সমস্যা রয়েছে কিন্তু সেটা পুরো ইউরোপেও ছড়িয়েছে। ইউরোপের আর কোনো দেশের পক্ষে এত বড় ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়।”
ফরাসি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ডিমের উচ্চমূল্যের কারণে প্রক্রিয়াকরণ করা কিছু খাবারের উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে কিংবা তাদের রেসিপি কাটছাঁট করতে পারে বলে জানান সিএনপিও’র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ফ্রান্সের ব্রিট্যানি এবং নরম্যান্ডি অঞ্চলে ১০ লাখ ডিম উৎপাদন করে ফরাসি শিল্প গ্রুপ সিএনপিও।
উইসকননসিস এর গ্রিন বে এলাকার কেক ও পেস্ট্রি শপের মালিক লিজ রেহবার্গ জানান, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ১৫ ডজন ডিমের দাম ২৬ ডলার থেকে বেড়ে ৪৫ ডলার হয়ে উঠেছে।
নিজের বেকারির খাবারের দাম বাড়ানো নয়তো আকার ছোট করার কথা ভাবছেন বলেও জানান তিনি।
রেহবার্গ বলেন, “আপনাকে এটা করতে হচ্ছে কারণ আপনার ডিম দরকার। এরপর আপনি দামের দিকে তাকিয়ে বলবেন, ওহ মাই গড।”