ক্যাটাগরি

জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় ভোগাচ্ছে নেপালকে

প্রায় ৩ কোটির জনসংখ্যার স্থলবেষ্টিত এ দেশের
অবস্থান ভারত আর চীনের মাঝখানে। জ্বালানিসহ প্রায় সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানির
জন্য তাদের অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় ভারতের ওপর।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা তাদের ইতিহাসে
সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট পার করছে। মূলস্ফীতির জেরে পাকিস্তান সরকারপতন দেখেছে কয়েক
দিন আগেই। নেপালের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে
বিবিসির এক প্রতিবেদনে।   

রাজধানী কাঠমান্ডুর সবজি বিক্রেতা পামফা
খত্রী বিবিসিকে বলেছেন, “প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে আর আমরা খরচ মেটাতে সংগ্রাম
করছি।”

৩৭ বছর বয়সী এই নারী দুই সন্তানের জননী।
পরিবারসহ কাঠমান্ডুর কাছে ভক্তপুর জেলায় থাকেন। প্রতিদিন ৩০ কেজির বেশি ওজনের সবুজ
শাক ভর্তি ঝুড়ি অনেক কষ্টে বাজারে টেনে নিয়ে আসেন।

ছবি: দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট

ছবি: দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট

খত্রীর দিন শুরু হয় ভোর ৩টায়, সেসময় আশেপাশের
খামার থেকে শাক-সবজি কিনতে বের হন। সেগুলো আবার গণপরিবহনে করে শহরে নিয়ে আসেন বিক্রির
জন্য। তাতে দিনে আয় হয় আড়াই হাজার রুপির মত।    

তিনি বলেন, “আমার স্বামী কাজ করে না। তাই
পুরো পরিবার আমার উপর নির্ভরশীল। আমার দুই ছেলের স্কুলের খরচও আমাকে দিতে হয়। নিত্য
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং পরিবহন খরচ বাড়ছে, জীবন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।”

বিবিসি লিখেছে, গত দুই বছরে খাদ্যপণ্যের
দাম যে গতিতে বেড়েছে, সেটাই খত্রীর মতো নেপালিদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর কোনো শেষ তারা দেখতে পাচ্ছেন না।

যেমন- রান্নার কাজে ব্যবহৃত এক লিটার সূর্যমূখী
তেল মহামারীর আগে ১৬০ রুপিতে বিক্রি হত। এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, গুনতে হচ্ছে প্রায়
তিনশ রুপি। 

ভোক্তা সংগঠনগুলোর হিসাবে বলছে, নেপালে বেশ
কিছু খাদ্য পণ্যের দাম এক বছরে ২০ শতাংশ বেড়েছে।

আমদানি নির্ভরতা

আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে হিমালয়ের দেশটির
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সাত মাসে ১৬ শতাংশ কমে ৯৫৯
কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

খাদ্য ও জ্বালানির মত প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে
নেপালকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ডলার জমা রাখতে হবে। আর সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে সরকারকে।
গাড়ি, প্রসাধনী ও সোনার মতো পণ্য, যেগুলো অপরিহার্য নয়, সেসব আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে।

ছবি: দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট

ছবি: দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট

নেপাল একা নয়, ভারত ও পাকিস্তানে মতো এ অঞ্চলের
সব দেশকেই ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্প্রতি তেলের
দাম বাড়িয়ে আরও চাপ বাড়িয়েছে। নেপালের রাষ্ট্রচালিত তেল করপোরেশন লোকসান পুষিয়ে
নিতে এ বছরের শুরু থেকে এরইমধ্যে চারবার জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে।

কাঠমান্ডুর সবজি ও কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীরা
এখনও সরবরাহ সংকটে পড়েননি, এখনও তারা শাক-সবজি, মাংস, মাছসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য বিক্রি
করে যাচ্ছেন। তবে অনেক বিক্রেতা বলছেন, ক্রেতারা এখন কিনছেন পরিমাণে কম। আবার দর কষাকষির
তিক্ততাও বেড়ে গেছে।

এক দোকানি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ার মানে
হল, শাকসবজি ও অন্যান্য পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক ও ভ্যানের জন্য আরও বেশি ভাড়া দিতে হবে।
তাতে পণ্যের দাম বাড়বেই। 

প্রতি বছর সড়কে শত শত নতুন যানবাহন যুক্ত
হওয়ায় নেপাল সরকার জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা কমানোর চেষ্টা করছে।

নেপালের যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী
জ্ঞানেন্দ্র বাহাদুর কারকি বলেন, “পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবহার কমাতে আমরা সপ্তাহের
শনিবার একদিন ছুটির পরিবর্তে দুই দিন ছুটি ঘোষণার কথা ভাবছি।”

ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল কমাতে শহরগুলোতে
নতুন নিয়ম চালু করার কথাও ভাবা হচ্ছে। জোড় ও বেজোড় নম্বর প্লেটের গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন
দিনে চলার নিয়ম করলে জ্বালানি সাশ্রয় হবে।

ভোক্তা অধিকার ফোরামের সুবর্ণা প্রভা গুরাগাইন
সতর্ক করে বলেছেন, মধ্যবিত্ত এবং খত্রীর মতো দিনে আয় করা পরিবারগুলো বেশি কষ্ট পাচ্ছে।
তারা খাবারের খরচ মেটাতে অন্যান্য খরচ কমাচ্ছে।

“খাদ্যের দাম নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। ২০১৫
সালে নেপালকে ধ্বংস করে দেওয়া ভূমিকম্পে যে অবস্থা হয়েছিল, তার চেয়েও পরিস্থিতি এখন
খারাপ। মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ।”

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

নেপালের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে রেমিটেন্স
থেকে। দেশটির ৩৫ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও ভারতে কাজ করেন।

২০২০ সালে প্রবাসীরা ৮০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছে,
যা মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি।

নেপালের অর্থনীতিবিদ ড. পোশ রাজ পাণ্ডে বলেছেন,
এই রেমিটেন্স নেপালের গ্রামীণ পরিবারগুলোর সহায়তার প্রধান চাবিকাঠি। মহামারী ও রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতার সময় তাদের সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করেছিল।

“মহামারীতে লকডাউনের কারণে মানুষ চাকরি হারিয়েছে
এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। ফলে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অতিরিক্ত
প্রায় ১২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।”

খাদ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষ নেপাল
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য ভালো খবর নয়। দেশটিতে শিগগিরই স্থানীয় নির্বাচন
এবং এ বছরের শেষের দিকে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে শ্রীলঙ্কার
যে অবস্থা হয়েছে, সেদিকে সতর্ক নজর রয়েছে নেপালি কর্মকর্তাদের। কিন্তু দাম বাড়ার বিপরীতে
আয় কমায় নেপালের অনেকেই অনিশ্চিত একটি অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন। 

সবজি বিক্রেতা খত্রীর মত অনেকেই ভাবছেন,
পরিবারে খরচ মেটাতে এখন তাদের অন্য কাজ খুঁজে বের করতে হবে, যাতে আয় কিছুটা বাড়ে।