ক্যাটাগরি

ইফতারি: হাজারো ‘রানার’ ছোটে শহরের পথেঘাটে

বেলা ফুরাবার আগে অসহনীয় যানজটের মধ্যে এই ‘বয়’দের সময়মত ইফতারি পৌঁছাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে দেখা যায়; রোদ আর গরমের কষ্ট মাড়িয়ে গন্তব্যে ছুটে চলেন তারা। তাদের এই ‘যন্ত্রণা’ নিয়ে গত বছর গান বেঁধেছিলেন ওপার বাংলার শিল্পী ড. সৌমিক দাস- ‘এই শহরটা চিরে দেয় উত্তরে দক্ষিণে, হাজারো ডেলিভারি বয়’।

‘যন্ত্রণা’ সহ্য করা এসব তরুণই নাগরিক জীবনকে সহজ করে দিয়েছেন। লকডাউনের সময় নগরবাসীর কাছে তারা পৌঁছে দিয়েছেন নিত্যপণ্যের বাজারের ঝোলা। এই রোজাতেও যা থেমে থাকেনি।

তারা জানাচ্ছেন, মহামারীকালের গত দুই রোজায় ইফতারির কেনাকাটায় অনেকেরই ভরসা ছিল অনলাইন মাধ্যম ও ক্লাউড কিচেন (ঘরে তৈরি খাবার ভার্চুয়ালি বিপণন)। সেই প্রবণতা এখন কমে এলেও রাজধানীর অনেক রেস্তোরাঁয় অনলাইনে বিক্রি এখনও বলার মতই।

ক্রেতা-বিক্রেতারা বলছেন, লকডাউন পেরিয়ে রাজধানীতে এখন যানজটের কারণে মানুষ সময় পাচ্ছে কম। অনেকেই নির্দিষ্ট দোকানের খাবার পছন্দ করেন। কেউ কেউ আবার বিশেষ কোনো খাবার নির্দিষ্ট দোকান থেকে নিতে পছন্দ করেন। এসব কারণেই এখনও অনেকে অনলাইনে ইফতারি কিনছেন।

পাঠাও ফুডের একজন ডেলিভারি পারসন মো. আলীম বলছেন, এখনও অনেকে অনলাইনে ইফতারের সময় অর্ডার করছেন। তবে সেটা সংক্রমণের আগের সময়ের চেয়ে কম।

“ইফতারে মানুষ এখনও অর্ডার করছে, তবে সেটা দুই বছরের মত না। অনেক সময় ইফতারের পরও অর্ডার পাই।”

বিক্রেতাদের কেউ কেউ বলছেন, লকডাউন না থাকায় ক্রেতাদের অনেকে আবার সরাসরি রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার কিনছেন। যে কারণে অনলাইনে খাবার বিক্রি কিছুটা কমেছে। আবার অনেকেই মনে করছেন, নির্দিষ্ট খাবারের দোকান ঘিরে একটা ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরি হওয়ায় এখনও চলছে অনলাইনে খাবার বিক্রি।

বছর দুয়েক আগে মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকায় চালু হয় সরিষাবাড়ি বিরিয়ানি। এর কিছুদিন পর বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীতে ঘরবন্দি হয় মানুষ। লকডাউনে সারাদেশের মানুষ তখন ঘরে। সেই সময় রোজার মাসে শুরু হয় হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা।

মহামারীর প্রাদুর্ভাব কাটলেও দোকানের ব্যবস্থাপক মো. রিফাত জানালেন, লকডাউনে হোম ডেলিভারির যে ঊর্ধ্বগতি ছিল সেটা ‘খুব একটা কমেনি’। যে কারণে এখনও এই ব্যবস্থা চালু রেখেছেন তারা।

“তখন মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারত না। আর এখন রোজার মধ্যে জ্যামের কারণে অনেকে সময় বাঁচাতে হোম ডেলিভারি নিচ্ছে। আমরাও তাই এই ব্যবস্থা চালু রেখেছি। আমরা হালিম আর বিরিয়ানি বিক্রি করছি। দোকানের নম্বর দেওয়া আছে। অর্ডার করলে আধা ঘণ্টার মধ্যে এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছি।”

দিনে কতগুলো হোম ডেলিভারি হয় জানতে চাইলে রিফাত বলেন, “সেটা আমরা হিসাব করিনি। সবইতো মহল্লা ও আশপাশের এলাকার মধ্যে।”

বেসরকারি একটি সংস্থায় কর্মরত আমজাদ হোসেন বাসার ইফতারির জন্য এখনও অনলাইন মাধ্যমের ওপর নির্ভর করছেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “এখন ঢাকা শহরের যে যানজট, সেখানে সময় করে ইফতার কিনতে যাওয়া একটা বিড়ম্বনা। গত দুই বছরে কয়েকটি দোকানের খাবারের মান ভালো লেগেছে, তাদের কাছ থেকে এখনও কিনছি। আর ঘরে বসে যদি কেনাকাটা করা যায়, তবে বাইরে যাওয়ার দরকার কী?”

রাজধানীর নর্দ্দার বাসিন্দা সোহানী ইসলাম চাকরি করেন একটি এনজিওতে। অফিসের কাজ শেষে ইফতারের বিশেষ কোনো খাবারের জন্য নির্ভর করেন পছন্দের ক্লাউড কিচেন বা রেস্তোরাঁর ওপর।

তিনি বলেন, “গত দুই বছর বেশ কিছু দোকান থেকে ডেলিভারি নিয়েছি। তাদের মধ্যে ২-৩টির ওপর ভরসা করি। মানও ভালো। সেজন্য ইফতারিতে হালিম বা বিরিয়ানি কেনার জন্য ওই দোকানগুলো থেকেই অর্ডার করি।“

“ইফতারির বিশেষ আইটেমগুলো দেখেই কিনতে চাই। সময় থাকলে কিনিও। তবে, কিছু জায়গার ওপর ভরসা তৈরি হয়েছে। যানজটের কারণেও অনেক সময় অনলাইন থেকে খাবার কিনছি।”

গত দুই বছর ইফতারের খাবারের অনেকটাই অনলাইনে কিনেছিলেন মারুফ হাসান। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মারুফ এ বছর দোকানে গিয়ে ইফতার কিনলেও কিছু কিছু খাবারের জন্য অনলাইনের ওপর নির্ভর করছেন।

নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহক পেয়েছেন ‘সাবরিনাস ডাইন’ নামের একটি ক্লাউড কিচেন। পুরান ঢাকার লালবাগে নিজের বাসায় বসেই এ ব্যবসা সামলান সাবরিনা করিম। প্রায় পাঁচ বছর ধরে আছেন খাবারের ব্যবসায়।

লকডাউনের দুই বছরের অনলাইনে যেমন ইফতারের অর্ডার পেয়েছেন, এবারও সাড়া কমেনি। আর এর কারণ নির্দিষ্ট গ্রাহক তৈরি হয়ে যাওয়া। তবে মহামারীকালের প্রাদুর্ভাব কমে আসায় ডেলিভারি চার্জ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে বলে জানালেন তিনি। পুরান ঢাকা থেকে ব্যবসা পরিচালনা করলেও সাবরিনা ঢাকার প্রায় সব অঞ্চলে ইফতার সরবরাহ করেন।

নবাবী ভোজ রেস্টুরেন্টের নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান চৌধুরী মনে করছেন, এখনও যারা অনলাইনে খাবার কিনছেন তারা ‘বাঁধা কাস্টমার’।

নিজেদের দৈনিক বিক্রির ২০-২৫ শতাংশ অনলাইনে পাওয়া অর্ডারের জানিয়ে তিনি বলেন, “গত দুই বছরের তুলনায় আমাদের অনলাইনে বিক্রি কম। কারণ গত দুইবছর রোজার সময় রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার উপায় ছিল না। এবার খোলা। মানুষ দেখে খাবার কিনছে।”

অবশ্য লকডাউনের সময় ইফতার বিক্রির যে হার ছিল, এখনও সেরকম রয়েছে বলে জানাচ্ছেন ফুডপান্ডার হেড অব পিআর সৌরভ দে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “‘ইফতারওয়ালা’ নামে বিশেষ আয়োজনটি এবছরও আমরা রেখেছি। ঢাকার উত্তরা, বসুন্ধরা, বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বেইলি রোড, মিরপুর এরিয়ায় রেস্তোরাঁর দেশি-বিদেশি বাহারি সব ইফতারির আইটেম পাওয়া যাচ্ছে।”

লকডাউনের সময় এবং বর্তমানে অনলাইনে ইফতারি কেনায় মানুষের আগ্রহ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনি যদি গ্রোথের কথা জানতে চান, তাহলে বলব, গত দুই বছরের সাথে এ বছর গ্রোথটা স্টেডি আছে।”

এর কারণ হিসেবে সৌরভ মনে করছেন ‘যানজট থেকে সময় বাঁচাতে’ মানুষ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। অনেকে কাজের সময় বাঁচাতে অনলাইনের ওপর নির্ভর করছে বলেও মনে করছেন তিনি।

মোহাম্মদপুরের বিসমিল্লাহ হোটেল মহামারীতে অনলাইনে খাবার বিক্রি শুরু করে। এখনও সেই ব্যবস্থা তারা রেখেছে। তবে হোটেলটির ব্যবস্থাপক আকরাম আলী ভাষ্য, “এখন অনলাইনে খাবার বিক্রি কম।”

অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইফতারের অর্ডার গত দুই বছরের চেয়ে এবার কম বলে জানিয়েছেন গুলশানের খাজানা রেস্টুরেন্টের সিইও অভিষেক সিনহা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ বছর রেস্টুরেন্ট খোলা। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ দেখে খাবার কিনতে চাইছে। আমাদের লাইভ কিচেন। যে কারণে পছন্দ মত অর্ডার করে নিচ্ছে। ডেলিভারিও যাচ্ছে, তবে গত দুই বছরের চেয়ে কম।

“অনেকেই আছেন সময় বাঁচানোর জন্য অনলাইনে কিনছেন। তারা রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে জানেন। সেকারণেই অনলাইনে অর্ডার করছেন।”