ক্যাটাগরি

শিবুলাল অপহরণ: মুক্তিপণের টাকায় ‘ব্যবসা করার স্বপ্ন’ দেখছিল অপহরণকারীরা

গ্রেপ্তার চারজন হলেন মুফতি মামুন ওরফে ল্যাংড়া
মামুন, টোলপ্লাজার কর্মী রানা ওরফে পিচ্চি রানা, বিআরটিসির বাস চালক জসিম উদ্দিন মৃধা
এবং রেন্ট-এ-কারের দালাল আশিকুর রহমান।

গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের সদস্যরা মঙ্গলবার
ঢাকার মিরপুর, ভাটারা এবং গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের
গ্রেপ্তার করে বলে বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ
কে এম হাফিজ আক্তার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, পটুয়াখালী জেলা পুলিশের অনুরোধে অপহরণকারীদের
ধরতে তারা অভিযান চালান।

গত ১১ এপ্রিল রাতে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা থেকে শহরের
বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হন ব্যবসায়ী শিবুলাল দাস ও তার গাড়ির চালক মিরাজ। তার গাড়িটি
বরগুনা জেলার আমতলীর আমড়াগাছিয়ার একটি তেলের পাম্পে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। 

অপহরণকারীরা শিবুলালের স্ত্রীকে
ফোন করে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। শিবুলালের ছেলে বুদ্ধদেব দাস বাদী হয়ে একটি
মামলা দায়ের করেন।

পরদিন পটুয়াখালীর কাজীপাড়ার
এসপি কমপ্লেক্স নামের একটি ভবনের বেজমেন্ট থেকে হাতপা ও মুখ
বাঁধা অবস্থায় ব্যবসায়ী
শিবুলাল ও তার চালককে উদ্ধার করে পুলিশ।

এরপর গত ১৭ এপ্রিল জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাসহ ছয়জনকে
গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়ে জেলার পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, মো. মামুন
ওরফে ল্যাংড়া মামুনসহ তিনজন এই অপহরণ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, যাদের তারা ধরতে পারেননি।

বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মামুনসহ
বেশ কয়েকজন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছে এমন তথ্য ছিল আমাদের কাছে। সেজন্য রিকুইজিশন
পাঠানো হয় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশকে। তারা চারজনকে গ্রেপ্তার করে আমাদের জানিয়েছে।”

ঢাকার সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম
হাফিজ আক্তার বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা উরু পর্যন্ত কেটে ফেলার পর মামুনের
নাম হয়ে যায় ‘ল্যাংড়া মামুন’।

“ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে সে তার দুটি
টর্চার সেলে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিত।

“মামুনের এবারের পরিকল্পনা ছিল, শিবুলালকে অপহরণ
করে মুক্তিপণ হিসেবে যে কোটি টাকা মিলবে, তা দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় গার্মেন্টস
কারখানা খুলে ব্যবসা শুরু করবে।”

গ্রেপ্তার রানা বিভিন্ন টোলপ্লাজায় টোল সংগ্রহের
কাজ করতেন, কখনো কাজ করতেন ট্রাক ভাড়ার দালাল হিসেবে।

হাফিজ আক্তার বলেন, “তৃণমূলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে
জড়িত থাকায় সেও ভেবেছিল, অপহরণ করে বড় অংকের টাকা মারতে পারলে তা দিয়ে কয়েকটা ট্রাক
কিনে সেও ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে ব্যবসা শুরু করবে।”

জসিম উদ্দিন মৃধা যহেতু নিজে বাস চালক, তিনি মুক্তিপণের
টাকা দিয়ে বাস কিনে ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে চালানোর স্বপ্ন দেখছিলেন বলে জানান গোয়েন্দা
কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার আশিক দীর্ঘদিন ধরে রেন্ট-এ-কারের
দালালি করতেন। তিনি ভেবেছিলেন, অপহরণের মুক্তিপণের টাকা দিয়ে একাধিক গাড়ি কিনে বড়
পরিসরে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা শুরু করবেন।”

এর আগে পটুয়াখালীর পুলিশের হাতে ধরা পড়া ছয়জন হলেন: জেলা স্বেচ্ছাসেবক
লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আতাউর রহমান পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ,
তার ভাই আক্তারুজ্জামান সুমন, মো. মিজানুর রহমান সাবু গাজী, মো. বিল্লাল ও সাব্বির
হোসেন জুম্মান। তারা সবাই পটুয়াখালীর শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।

যেভাবে অপহরণ করা হয় শিবুলালকে

জিজ্ঞাসাবদে গোয়েন্দা পুলিশ জেনেছে, পটুয়াখালীর
লঞ্চঘাটের কাছাকাছি মামুনের অফিসে বসে এই চার জন অপহরণের পরিকল্পনা আঁটে গত ফেব্রুয়ারিতে।
সে অনুযায়ী ১০ হাজার টাকা আগাম দিয়ে একটি গাড়ি ভাড়া করে।

নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তারা সাভার থেকে পাঁচটি
বাটন ফোন কেনে এবং বেশি দাম দিয়ে অন্যজনের নামে নিবন্ধিত সিম কেনে পটুয়াখালী জেলা সদর
থেকে।

এছাড়া স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয় একটি খেলনা পিস্তল, দুটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাপাতি এবং গরু
জবাই করার একটি বড় ছুরি। একাধিক দিন রেকি করে ১১ এপ্রিল রাতে তারা মূল কাজ শুরু করে।

কীভাবে সেদিন শিবুলালকে অপহরণ করা হয়েছিল, তার বিবরণ সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন দুপুরবেলা পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের
কাছে মিলিত হয় অপহরণকারীরা। তাদের পাঁচজন সন্ধ্যা ৭টার দিকে পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে
রোডের শাঁখারিয়ার নির্জন জায়গায় একটা প্রাইভেট কার এবং একটা ট্রলি নিয়ে
অবস্থান নেয়।

মামুনের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল (পটুয়াখালীর পুলিশ
তাকে গ্রেপ্তার করেছে) আগেই একটি ট্রাক্টর ভাড়া করে। আর প্রাইভেটকারটি নিয়ে চারজন
অপেক্ষায় থাকে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য।

“সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে মামুনের সংকেত
পেয়ে বিল্লাল ট্রলি নিয়ে শিবু দাসের গাড়ির পথ আটকায়। আশিক গিয়ে শিবু দাসের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। গাড়িতে
উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ,
আশিক মিলে  বেঁধে ফেলে শিবু দাস ও মিরাজকে। গামছা, টিস্যু
পেপার এবং  টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চলতে থাকে চড়-থাপ্পড়
কিল ঘুষি।”

সঙ্গে থাকা খেলনা পিস্তল ও চাকু দিয়ে ভয় দেখানো
হয় শিবুলাল ও তার গাড়ি চালককে। অপহরণকারীরা তাদের ভাড়া করা গাড়িতে তুলে দুজনকে নিয়ে
যায় বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায়। সেখানে আরো ভালোভাবে দুজনকে বেঁধে প্লাস্টিকের
বস্তায় ঢোকানো হয়। এর মধ্যেই শিবুলালের গাড়িটি ফেলে আসা হয় আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, রাতে শিবুলাল ও মিরাজকে এসপি
কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে মামুনের ‘টর্চার সেলে’ নিয়ে যায় অপহরণকারীরা।
বিল্লাল রাত পৌনে ২টার দিকে শিবুলালের ফোন থেকে তার স্ত্রীকে ফোন করে পরদিন দুপুর
২টার মধ্যে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিতে বলে। টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে
শিবুলালকে হত্যা করে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে
ব্যবহৃত প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন,
গামছা এবং চার হাজার ইয়াবা উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।