প্রায় এক দশক ধরে এই ভোগান্তি পোহাতে থাকা এই পথের যাত্রী ও পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এবার ঈদেও একই ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন। যদিও বিআরটি কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈদকে প্রাধান্য দিয়ে সড়কটি ঠিক করার কাজ চলছে।
২০১২ সাল থেকে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারে। চার বছর মেয়াদী এ প্রকল্প কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে এবং বাজেট দ্বিগুণ করে এখন পর্যন্ত ৭৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে তুরাগ সেতু পর্যন্ত আট কিলোমিটার রাস্তায় তেমন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর পরের ১২ কিলোমিটার রাস্তার চিত্র ভয়াবহ; সেখানে গাড়ির জটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ভয়াবহ নাজেহাল হতে হয় যাত্রীদের।
গাজীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান আহমদ সরকার বলেন, “টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা ১২ কিলোমিটার। টঙ্গী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কে খানাখন্দ ও ভাঙাচোরা থাকলেও বাকি অংশে নেই। সড়কে গত কয়েক বছর ধরে বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। যার কারণে ১২ কিলোমিটার অতিক্রম করতে এখন সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। কখনও কখনও এর চেয়েও বেশি।”
“করোনাভাইরাসের মহামারীর বিধিনিষেধ এবার না থাকায় গত দুই বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি মানুষ এবার গ্রামের বাড়ি যাবে। এতে রাস্তায় যাত্রী ও গাড়ির সংখ্যা বাড়বে। ফলে অসমাপ্ত এ মহাসড়কে ঈদযাত্রায় এবার চরম ভোগান্তি হবে।”
গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি-ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সড়কে মেগাপ্রকল্প চললে যানবাহন চলাচলে সাময়িক সমস্যা হবেই। কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে বিআরটি কর্তৃপক্ষকে দ্রুত সমাধানের জন্য বলা হয়েছে।
একটি জরিপের বরাত দিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৬০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। আর ঈদের আগে এই সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
ঈদ উপলক্ষে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে ট্রাফিক পুলিশের ৩০০ সদস্য ছাড়াও মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত ১০০ সদস্য নিয়োজিত থাকবে বলে জানান আব্দুল্লাহ আল মামুন।
বিআরটি কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১২ থেকে কাজ চলছে। দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর করা হয় এবং ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ ১৪ টাকা। সবশেষ দুই দফা প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর বিভিন্ন স্থানে ২৫টি স্টেশন হবে।
এখন টঙ্গীর হোসেন মার্কেট, কুনিয়া, বড়বাড়ি, বোর্ডবাজার, ছয়দানাসহ বেশকিছু স্থানে রাস্তার মাঝখানে ১৮টি স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। এতে ওইসব এলাকায় রাস্তা সরু হয়ে যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে বলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের
উপ-কমিশনার (ডিসি-ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান।
তিনি বলেন, এ ছাড়া স্টেশন রোড়ের পশ্চিমে, গাজীপুরার বাঁশপট্টিসহ কয়েকটি এলাকায় ময়মনসিংহমুখী দুই লেন থাকলেও তা মিলানো হয়নি। দুই লেনের মাঝখানে খালি রয়েছে। ঢাকামুখী লেনে চেরাগ আলী অনুদ্বীপ সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে মিল গেইট পর্যন্ত রাস্তার নির্মাণ করা হয়নি। পুরাতন এ রাস্তাটির স্থানে স্থানে খানাখন্দতে ভরা।
মহাসড়কের পাশে নির্মিত ড্রেনের মুখে ঢাকনা না দেওয়ার কারণেও ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটে যানজট হচ্ছে। এ ছাড়া অল্প বৃষ্টি হলেই কুনিয়া, তায়রুন্নেছা মেডিকেল, হোসেন মার্কেট, ভোগড়া, বাসন, মধুমতিা রোড ও টঙ্গী হাসপাতালের সামনে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
মঙ্গলবার টঙ্গীর তুরাগ সেতু থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, বিআরটি প্রকল্পের ওপরে উড়ালসড়ক এবং নিচে কার্পেটিং এখনও অনেক জায়গায় শেষ হয়নি। কাজের কারণে চার লেনের মহাসড়ক কোথাও তিন লেন, কোথাও দুই লেনে পরিণত হয়েছে। এতে যানবাহনের গতি খুবই ধীর, সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।
চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বেশ জটলা লেগে থাকে। বিআরটি প্রকল্পের কারণে যানবাহনগুলি তাদের স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। দুইদিকে থেমে থেমে যানজট।
ভোগড়া বাইপাস মোড়ে সড়কের দুপাশে স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলতে দেখা গেছে। তবে গাড়ির চাপ বেড়ে গেলে তখন সংকুচিত সড়কে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
এরপর গাছা, মালেকের বাড়ি, বোর্ডবাজার, কুনিয়া বড়বাড়ি এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের স্টেশন তৈরির কাজ চলমান থাকায় সেখানে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
গাজীপুরা এলাকায় সড়কের মাঝে উড়ালসড়ক তৈরির ব্লক রেখে দেওয়ায় দুপাশে সংকুচিত সড়ক দিয়ে থেমে থেমে যানবাহন চলছে। একই অবস্থা গাজীপুরা অতিক্রম করে চেরাগ আলী আফতাব সিএনজি স্টেশন ও ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনে।
টঙ্গীর মিল গেইট থেকে তুরাগ সেতু পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার সড়কের কার্পেটিং না কারায় সেখানে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। এর মধ্যেই যানবাহন হেলেদুলে চলছে।
গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় ব্যবসায়ী আক্রাম হোসেন বলেন, “দীর্ঘদিন হয়ে গেছে সড়কের মাঝে উড়ালসড়ক তৈরির ব্লক রেখে দেওয়া হয়েছে। এত দুই পাশের সড়ক ছোট হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই এখানে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ঈদের আগে ব্লকগুলি সরিয়ে দেওয়া হলে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে।”
এনা পরিবহনের বাসচালক আবু তাহের বলেন, “ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বড় একটি সমস্যা রাস্তায় পানি জমে থাকা। বৈশাখের শুরু থেকে বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই হিসাবে ঈদের আগেও বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে টঙ্গী থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে।
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে ভালুকা পর্যন্ত প্রচুর শিল্প-কলকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু গাজীপুরেই রয়েছে পাঁচ হাজারের অধিক কারখানা। এখানে লাখ লাখ শ্রমিক বসবাস করেন। ঈদের ছুটিতে এসব শ্রমিক বাড়ি যাবেন। অনেক শ্রমিক পরিবার নিয়ে পাবলিক বাসেই ঘরমুখো হন। আবার অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা রিজার্ভ গাড়ি করে বাড়ি যান।
জিএমপির ডিসি (ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, শ্রমিকদের ঈদের ছুটি একসঙ্গে দিলে অনেক সমস্যা হবে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছুটি দিতে হবে। আর শ্রমিকদের রিজার্ভ বাসগুলো মহাসড়কে পার্কিং করা যাবে না।
বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ সাংবাদিকদের বলেন, “পুরো প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন ঈদযাত্রাকে প্রাধান্য দিয়েই কাজের গতি আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঈদের আগে সড়কে নীচের যে অংশে কার্পেটিং বাকি রয়েছে সেগুলি শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
“আশা করি, ঈদের যাত্রার আগেই সড়কটি পুরোপুরি চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে।”
বিআরটি প্রকল্প সম্পর্কে:
ঢাকার জন্য ২০০৫ সালে করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) আওতায় বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে বাসের আলাদা লেন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটাই বিআরটি প্রকল্প, যা ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়।
প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলিভেটেড বিআরটি লেইন, ছয়টি ফ্লাইওভার, ২৫টি বিআরটি স্টেশনসহ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে দুটি বিআরটি লেন, চারটি মিক্সড ট্রাফিক লেন, দুটি অযান্ত্রিক লেন ও পথচারীর জন্য পাতালপথসহ সড়কের উভয় পাশে থাকবে ৬৫টি সংযোগ সড়কসহ অন্যান্য সুবিধা। চারটি সংস্থাকে ভাগ করে কাজ দেওয়া হয়েছে।
বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক মো. মহিরুল ইসলাম খান বলেন, ২০১২ সালে প্রকল্প অনুমোদন পেলেও ২০১৭ পর্যন্ত প্রকল্পের নকশা তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম করা হয়। আর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঠিকাদারদের এ প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওয়ার্ক সিডিউল অনুযায়ী কাজ চলছে।
২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এখন নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থসংকটে পড়েছেন এ প্রকল্পের ঠিকাদারেরা। তারপরও অর্থের এ তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
নতুন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হলে নির্ধারিত সময়েই প্রকল্পটির কাজ শেষ করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন মহিরুল ইসলাম খান।