শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন ছিল ২৩ রান। সোহান এক ওভারেই ২৬ নিয়ে খেলা শেষ করে দিলেন ৬ বল বাকি রেখেই। রূপগঞ্জ টাইগার্সকে ৪ উইকেটে হারিয়ে ট্রফি জয়ের দিকে আরেকধাপ এগিয়ে গেল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব।
ম্যচের শেষ দিকে যেমন ছিল রোমাঞ্চ, এর আগে ছিল লড়াই। সেই লড়াইয়ের যোদ্ধা সোহান। রূপগঞ্জকে ২৪৭ রানে থামিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে শেখ জামাল পড়ে যায় ব্যাটিং বিপর্যয়ে। ৮১ রানের মধ্যে হারায় তারা ৫ উইকেট। এর মধ্যে ছিল লিগে প্রথম খেলতে নামা মুশফিকুর রহিম এবং গোটা লিগে অসাধারণ পারফর্ম করা পারভেজ রাসুলও।
সেই ধ্বংসস্তুপ থেকেই দুর্দান্ত স্কিল আর টেম্পারমেন্টের ছাপ রেখে সোহান এগিয়ে নেন দলকে। তাকে সঙ্গ দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। রান আউটে মিরাজ বিদায় নিলেও সোহান থেকে যান শেষ পর্যন্ত। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে শেষ সময়ের রান রেটের দাবি মিটিয়ে দলের জয় সঙ্গে নিয়ে যখন ফিরছেন তিনি, নামের পাশে তখন জ্বলজ্বল করছে ১১৮ বলে ১৩২ রান।
১০ চার ও ৫ ছক্কার ইনিংসটি হয়তো এবারের লিগের সেরা ইনিংস।
সোহানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস তো বটেই। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তার সেঞ্চুরি ছিল আগে দুটি। ২০১৮ সালে শেখ জামালের হয়ে ১০০, ২০১৬ সালে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে ১০৮।
শেখ জামালের জয়ে পার্শ্বনায়ক এ দিন মিরাজ। দারুণ বোলিংয়ে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতে খেলেন ৪৩ রানের মহামূল্য ইনিংস।
শেষ দিকে যার ওপর ঝড় বইয়ে দেন সোহান, সেই মুকিদুল শেখ জামালকে নাড়িয়ে দেন রান তাড়ার শুরুতে। তরুণ পেসারের আউট সুইঙ্গারে রবিউল ইসলাম রবি বিদায় নেন শূন্য রানে, অনেক বাইরের বলে আলগা শটে আউট হন সাইফ হাসান।
এরপর অধিনায়ক ইমরুল কায়েসও অল্পতে বিদায় নিলে ৩৩ রানে ৩ উইকেট হারায় শেখ জামাল।
সেই বিপর্যয়ে কিছুটা হাল ধরেন জাতীয় দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ফেরার পর খেলতে নামা মুশফিক। সোহানের সঙ্গে তার জুটি জমে উঠতে থাকে।
মুশফিক এই লিগে ছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। তবে তাদের হয়ে মাঠে নামার আগেই দল ছিটকে পড়ায় তিনি নাম লেখান শেখ জামালে। শুরুটা করেছিলেন বেশ ভালো। কিন্তু শেষটা হতাশার। মোহাম্মদ শরিফ উল্লাহর অফ স্পিনে দায়িত্বজ্ঞানহীন শটে ক্যাচ দেন তিনি লং অনে (৪২ বলে ৩২)।
একটু পরই এনামুল হক জুনিয়রের টার্ন না করা সোজা বলে যখন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন ভারতীয় অলরাউন্ডার পারভেজ রাসুল, শেখ জামালের পরাজয় দেখছিলেন তখন অনেকেই।
কিন্তু সোহানের মনে ছিল হার না মানার প্রত্যয়। মিরাজ তো ইদানিং সব জায়গাতেই দারুণ আত্মবিশ্বাসী। দুজনর লড়াইয়ে জেগে ওঠে শেখ জামালের আশা।
দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ঝুঁকি না নিয়ে ইনিংস গড়েন সোহান। ফিফটি পূর্ণ করেন ৬৫ বলে। সময়ের সঙ্গে বাড়ান রানের গতি। দারুণ সব ক্রিকেটীয় শটের সঙ্গে উদ্ভাবনী নানা শট তো ছিলই। ৮৯ থেকে মুকিদুলকে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কায় উড়িয়ে পৌঁছে যান ৯৫ রানে। শতরানে পা রাখেন ১০৯ বলে।
তার ৯৯ রানেই দল ধাক্কা খায় আরেকটি। মিড অফে বল ঠেলেই রান নিতে ছোটেন মিরাজ, সরাসরি থ্রোয়ে তাকে রান আউট করে দেন রূপগঞ্জ অধিনায়ক মার্শাল আইয়ুব। ষষ্ঠ উইকেটে ১৩৪ রানের জুটি ভেঙে যায়, শেখ জামালও পড়ে যায় একটু শঙ্কায়।
কিন্তু সোহান ছিলেন যেন স্বপ্নের মতো ফর্মে। সেঞ্চুরির পর আরও দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে দলকে জিতিয়ে দেন তিনি দারুণ প্রত্যয়ে।
দিনের শুরুতে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা রূপগঞ্জের শুরুটা খারাপ ছিল না। ১০ ওভারে তারা রান তোলে ৪৪। এরপরই তিন বলের মধ্যে আউট হন আজমির আহমেদ ও তিনে নামা আসিফ আহমেদ রাতুল।
দুই অভিজ্ঞ মার্শাল আইয়ুব (২৩) ও ফজলে মাহমুদ (২৫) আউট হয়ে যান থিতু হয়েও। ওই সময়টায় দলকে টানেন জাকির হাসান। দারুণভাবে লিগ শুরু করা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান পরে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ৭ ইনিংস পর আবার তিনি করলেন ফিফটি।
৯৮ বলে ৭৫ করে তিনি আউট হয়ে যান অফ স্পিনার রাসুলকে স্লগ করতে গিয়ে।
রূপগঞ্জ তবু আড়াইশর কাছে যেতে পারে সাদ নাসিমের ফিফটি ও শেষ দিকে নাসুম আহমেদের ক্যামিও ইনিংসে। পাকিস্তানি অলরাউন্ডার নাসিম অপরাজিত থাকেন ৪৩ বলে ৫০ করে। নাসুম করেন ১৭ বলে অপরাজিত ২৭। দুজনে গড়েন ৩৩ বলে ৫৫ রানের জুটি।
কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা পরে চাপা পড়ে গেল সোহানের দুর্দান্ত ইনিংসে। ম্যাচ শেষে শেখ জামালের ক্রিকেটার-কর্মকর্তারা এবং খেলা দেখতে আসা শেখ জামাল একাডেমির একগাদা খুদে ক্রিকেটার যে উল্লাস করলেন, তাতে মিশে থাকল যেন সম্ভাব্য শিরোপার রোমাঞ্চও।
লিগের তিন ম্যাচ বাকি থাকতে তাদের পয়েন্ট ২২, দুইয়ে থাকা লেজেন্ডস অব রূপগঞ্জের পয়েন্ট ১৮। শিরোপা ঘ্রাণ ইমরুল-সোহানরা পেতেই পারেন!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
রূপগঞ্জ টাইগার্স: ৫০ ওভারে ২৪৭/৬ (আজমির ১৪, জাকির ৭৫, আসিফ ০, মার্শাল ২৩, ফজলে মাহমুদ ২৫, সাদ ৫০*, শরিফউল্লাহ ১৫, নাসুম ২৭*; ইবাদত ৭.১-০-৩৫-০, রাসুল ১০-০-৩৮-১, মিরাজ ১০-০-৪০-৩, সানজামুল ৯-০-৪৬-২, রবি ৩-০-১৫-০, মৃত্যুঞ্জয় ৯-০-৫১-০, জিয়া ১.৫-০-১৯-১)
শেখ জামাল: ৪৯ ওভারে ২৫১/৬ (সাইফ ১১, রবি ০, ইমরুল ১২, মুশফিক ৩২, সোহান ১৩২*, রাসুল ১, মিরাজ ৪৩, জিয়া ৩*; নাসুম ৯-১-৩৬-০, মুকিদুল ১০-১-৭৬-২, শরিফইল্লাহ ১০-১-৩৪-১, নাহিদ ৪.১-০-২২-১, এনাম জুনিয়র ৮.৫-০-৩৯-১, সাদ ১-০-৭-০, ফজলে মাহমুদ ১-০-৮-০, আসিফ ৫-০-২৫-০)
ফল: শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ৬ উইকেট জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: নুরুল হাসান সোহান