ক্যাটাগরি

পর্যটন শিল্পে প্রণোদনার আহ্বান

করোনাভাইরাসের প্রভাবে যে সকল কার্যক্রমের
উপর আঘাত হেনেছে, পর্যটন এদের মধ্যে অন্যতম।

সারা বিশ্বে বন্ধ করা হয়েছে এয়ারলাইন্স।
তার প্রভাবে বন্ধ হয়েছে হোটেল, রিসোর্ট, ক্রুজলাইন, রেস্তোরাঁ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ট্যুর
অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সিসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পর্যটন প্রতিষ্ঠান। বড় শিল্পখাত হিসেবে
বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই শিল্প।

সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
আমাদের এখানেও করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রথমেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসামরিক বিমান
চলাচল ও দেশের সকল পর্যটন কেন্দ্র। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে পর্যটন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
সকল ধরনের কর্যক্রম। পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ উৎকণ্ঠা ও হতাশায়
দিন কাটাচ্ছেন।

এমনাবস্থায় ৩০ মার্চ ২০২০-এ প্রকাশিত
প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন ‘চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পর্যটন খাতের সাড়ে
৭ কোটি কর্মী’ নজরে আসে। প্রতিবেদক সংবাদের এক জায়গায় লিখেছেন ‘১৬ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান জানিয়েছেন,
পর্যটন মৌসুমে বাংলাদেশে সাড়ে চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা লেনদেন হয়।’

অন্যদিকে টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাফেউজ্জামান
৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন। একদিকে ৭ কোটি কর্মী চাকুরি হারালে এই শিল্পখাত
কত বড়, এই প্রশ্ন সুধীজন থেকে সাধারণ মানুষের কাছে নতুন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২ এপ্রিল আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত
‘করোনায় হুমকিতে পর্যটন, সহায়তা চান উদ্যোক্তারা’ প্রতিবেদনে আরেকটু বিস্তারিতভাবে
ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করেছে।

বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিমান ২৭০ কোটি টাকা
ক্ষতির কথা বলেছে, ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত শুধু বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো
ব্যবসা হারাবে ৬০০ কোটি টাকার। চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে ২ হাজার কর্মীর। হোটেল,
রিসোর্টে লোকসান হবে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার, যেখানে চাকরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে ১ লাখ
মানুষের। তিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারাবে ট্রাভেল এজেন্টরা, চাকরি হারাতে পারেন
১৫ হাজার।

ট্যুর অপারেটররা (ইনবাউন্ড, আউটবাউন্ড,
ডমেস্টিক, ওমরাহ) ব্যবসা হারাবেন ৪ হাজার পাঁচ কোটি টাকার। এ ছাড়া ৪১ হাজার মানুষ হারাতে
পারেন তাঁদের চাকরি। তাছাড়া রেস্তোরাঁ, কফিশপ, ফাস্টফুড, বার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান
ব্যবসা হারাবে ৫০০ কোটি টাকার এবং চাকরি হারাতে পারে ১ লাখ ৫০ হাজার কর্মী।

পর্যটকবাহী যানবাহন (ট্যুরিস্ট ভেহিকল
ও ভ্যাসেল) খাতে ব্যবসা হারাবে ৫৫ কাটি টাকার, চাকরি হারাতে পারেন এক হাজার ৫০০ জন।

এই হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯,৯২৫
কোটি টাকায় এবং চাকরি হারাবে প্রায় ২ লক্ষ ৯ হাজার ৫০০ কর্মী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে প্রেরিত
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ (ট্রিয়াব)-এর আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শুধু
রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিতেই বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ
লোক প্রত্যক্ষভাবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত।

এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, সমগ্র
পর্যটন বাজারের একটি অংশ জুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উদ্যোক্তা। গবেষকগণ বলছেন,
কেবল ট্যুর অপারেটরদের অন্তত ৪০ শতাংশ রয়েছে পারিবারিক পর্যায়ের। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম
নয়।

পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশের পর্যটন
নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। ফলে যে কোনো মৌলিক তথ্য-উপাত্তের জন্য
আমাদেরকে বিদেশি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই ঘাটতি শিগগিরই
পূরণ করা উচিত। যদি বুঝতে চাই বাংলাদেশের পর্যটনখাত কত বড়!

উত্তর পাওয়া কঠিন এবং যা পাওয়া যাবে তা
এদেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়াও কঠিন। তাই বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্যের ভিত্তিতে
একটি হাইপোথিসিস তৈরির চেষ্টা করছি।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সি,
লন্ডন (ডব্লিউটিটিসি)-এর তথ্য মতে বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০১৯ সালে পর্যটনের অবদান ছিল
৭৭,৩০০ কোটি টাকা। আসল কথা হল বাংলাদেশের পর্যটনখাত পর্যালোচনা করার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত
প্রয়োজন তা সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। এ যাবত যে ক্ষয় ক্ষতির কথা আলোচানা হয়েছে তা সবই
অনুমান নির্ভর প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। 

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের
সিনিয়র সচিব জনাব মহিবুল হক বলেছেন, “এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই করোনাভাইরাসের কারণে
বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু ক্ষয় ক্ষতির সঠিক পরিমাণ কেউ বলতে পারছেন না।”

পর্যটন ১০৯টি উপখাতকে সরাসরি প্রভাবিত
করে, চালিত করে ও প্রসারিত করে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে প্রতি ১০ জনে ১ মানুষের
প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পায় আরও ৩৩ জন। অর্থাৎ ১ লক্ষ পর্যটকের আগমনের
সঙ্গে ৪৪ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। কোনো স্থানে যদি বছরে ১০ লক্ষ অভ্যন্তরীণ ও
আন্তর্জাতিক পর্যটক বিচরণ করে তবে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে এর সুফল
ভোগ করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি শিল্পের মধ্যে পর্যটন
অন্যতম।

ডব্লিউটিটিসি ধারণা করছে বিশ্বব্যাপী
করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্পে বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি লোক তাদের চাকুরি
হারাবে। এশিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তাদের আশঙ্কা। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব
শেষ হয়ে গেলেও শিল্পটি পুনরুদ্ধাওে অন্তত ১০ মাস পর্যন্ত সময় লাগবে।

‘দি ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম ফোরাম ইন্সটিটিউট’
এর প্রধান বুলেট বাগসি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, “করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে
বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্প ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাপী পর্যটন বাজার
বছরে গড়ে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার আয় করে এবং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক
ক্ষতি ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে যা বছর শেষ হতে হতে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌছাবে
বলে ধারণা করা হচ্ছে।”

বাংলাদেশও এই ক্ষতির বাইরে নয়।

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে হোটেল ও বিমান
মিলে ১০ ভাগ ব্যবসায়ী করপোরেট শ্রেণির, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৮০ ভাগ এবং ১০ ভাগ
প্রান্তিক শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। ফলে পর্যটনের সাথে মূলতঃ ৯০ ভাগ পেশাজীবী ও কর্মী অত্যন্ত
নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে, যা অন্য যে কোন উৎপাদনধর্মী এবং সেবাধর্মী শিল্পের চাইতে
আলাদা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা আক্রান্ত
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন
তা বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই ঘোষণা থেকে এ কথা পরিস্কার হয়েছে যে,
তিনি বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং তা থেকে উদ্ধার করার
জন্য সদা সচেষ্ট।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে স্বাগত
জানিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে আগামী জুন ২০২১ পর্যন্ত
প্রণোদনা ঘোষণা করতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স
অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে থেকে ৫টি উপায় তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের দাবি তোলা হয়েছে।

মাসুদুল হাসান জায়েদী। ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশন।

মাসুদুল হাসান জায়েদী। ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশন।

 

উপায়গুলো হল

ক) বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনের অবদানের
অন্তত ২৫ ভাগ অর্থাৎ ১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে। এই প্রণোদনার
টাকা বাস্তবসম্মত নীতিমালার আওতায় এককালীন অনুদান, রিফাইন্যান্সিং ঋণ ও রেয়াতি সুদহারে
ঋণ প্রদান করতে হবে।

খ) অনুদান ও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রান্তিক
শ্রেণির ব্যবসায়ী, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও করপোরেট ব্যবসায়ী এই ধারাক্রম মেনে
চলতে হবে।

গ) ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরকে
রক্ষার জন্য এপ্রিল ২০২০ মাসের মধ্যে অনুদানের অর্থ পর্যটন ব্যবসায়ীদের হাতে জরুরিভিত্তিতে
পৌঁছাতে হবে।

ঘ) বিতরণকৃত সকল ঋণ সরলসুদে প্রদান ও
দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ কিস্তি নির্ধারণ করতে হবে।

ঙ) ২০১৯-২০২০ এবং ২০২০-২০২১ করবর্ষে পর্যটনের
সকল উপখাতে ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স হ্রাস করতে হবে।

পর্যটন শিল্পকে এখন আর হাল্কাচালে বিবেচনা
করার অবকাশ নেই। পর্যটন এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে পণ্য নয়, সেবা রপ্তানি করেই বৈদেশিক
মুদ্রা দেশে আসে সেই সঙ্গে দেশের বেকারত্ব ঘোচাতে এই শিল্পের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর
করার সুযোগ রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর পরিকল্পনা।
এই খাত টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের এখনই সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন এবং বর্তমান সংকট মোকাবেলায়
এ খাতে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া করা জরুরি বলে মনে করছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরারস
অ্যাসোসিয়েশন (বিটিইএ)।

লেখক: মাসুদুল হাসান জায়েদী। ভাইস চেয়ারম্যান,
বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশন।