ক্যাটাগরি

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা: যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় ধরাচ্ছেন বিচ্ছিন্ন পুতিন

খুব ভেবে-চিন্তে রীতিমত ছক কষে সদ্যই নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার দেশকে যারা (পশ্চিমারা) ‘হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছে’ তাদের জন্য একে সতর্কবার্তাও বলছেন তিনি।

পুতিনের এমন হুঁশিয়ারি উদ্বেগে থাকা বাইডেন প্রশাসনে আরও ভয় ধরিয়েছে। রাশিয়া এখন বাদবাকী বিশ্ব থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যে, পুতিন আর উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডকে খুব একটা খারাপ চোখে দেখছেন না- যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা এখানেই।

অবশ্য রাশিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা এবং বিদেশি নেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। তাদের চিন্তা ছিল, তারা যতটা সফলভাবে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে রাশিয়াকে বাদ দিতে পেরেছেন, কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পেরেছেন, সেটি পুতিনকে তার নিজে দেশের ক্ষমতা জাহির করতে আরও উসকে দেবে কিনা।

বুধবার রাশিয়া প্রথমবারের মত তাদের পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ‘সারমাত’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। পুতিন কীভাবে আবারও বিশ্বকে তার সক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন, তার সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা।

গত সপ্তাহে রাশিয়া সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামের। বৈঠকের পর পুতিন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধ নিয়ে তিনি এখন তার নিজস্ব যুক্তিতেই আছেন।”

পূর্ব ইউরোপকে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে এবং পশ্চিমাদের থেকে রাশিয়ার প্রতি হুমকি যেভাবে বাড়ছে তা মোকাবেলায় পুতিন বর্তমানে যতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ততটা অতীতে কখনও তাকে দেখা যায়নি বলেও মনে করেন নেহামের।

সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নসও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেন, “উঠতি শক্তিগুলোর মতো ক্ষয়িষ্ণু শক্তিগুলোও যে অন্তত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে পুতিন তা প্রতিদিনই দেখিয়ে চলেছেন।”

‘‘রাশিয়ার ওপর পুতিনের নিয়ন্ত্রণ যত পোক্ত হয়েছে তার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষুধাও তত বেড়েছে”, বলেন বার্নস।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আরও খোলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্ন পুতিন কতটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেন তা নিয়ে কথা বলছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘‘আমরা এতটাই সফলভাবে পুতিনকে বৈশ্বিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পেরেছি যে, তিনি ইউক্রেইনের বাইরে গিয়ে সেটিকে ব্যাহত করতে আরও বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন।

‘‘এবং যদি তিনি ক্রমশ মরিয়া হয়ে ওঠেন, তিনি হয়ত এমন কিছু করার চেষ্টা করবেন যেটা যুক্তিযুক্ত হবে না।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পুতিনের বিষয়ে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধান নিয়ে আলোচনার সময় বলেন, ‘‘পুতিন কে মূল্যায়ন শেষ হয়েছে এবং সেটি হোয়াইট হাউজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তিনি বিশ্বাস করেন তিনিই জিততে চলেছেন এবং তিনি নিশ্চিতভাবে সেভাবেই পদক্ষেপ নিচ্ছেন।”

কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং তার দেশকে নতুন অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি পাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা বা এখন কিছু নিত্যপণ্য না পাওয়া কিছুই তাকে পিছু হটাতে পারবে না। তার এ আচরণে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

তিনি হরহামেশাই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেছেন। তার যুক্তি, তিনি সহজেই তার চারপাশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

সোমবার পুনরায় এই একই কথা বলেছেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখনই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে এই প্রবল আক্রমণের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।”

তবে পুতিন যতই বলুন পশ্চিমা কৌশল ব্যর্থ হয়েছে, তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কিন্তু সে কথা বলছেন না।

রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে হয়ত এই সমস্যা অতটা অনুভূত হচ্ছে না। কারণ, অর্থনীতিতে এখনো রিজার্ভ রয়েছে।

‘‘কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রায় প্রতিদিনই কঠোর থেকে কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা আসছে। ফলে অর্থনীতি যখন রিজার্ভের উপর নির্ভর করে চলবে তখন সেটা অসীম হবে না।”

ওই বাস্তবতা পুতিন এখন বুঝতে পারছেন বলে তো মনে হচ্ছে না। বরং পুতিন দিন দিন আরো যুদ্ধবাজ হয়ে উঠছেন। তিনি মারিউপোল, ইউক্রেইনের উপর নতুন করে গোলাবর্ষণে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রুশ বাহিনী পুরো দনবাস অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে।

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর নেহামেরের মতো যেসব নেতা এখন পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তাদের তিনি ‍জোর দিয়ে এটাই বোঝাতে চাইছেন, তিনি এখনও তার লক্ষ্য পূরণে অবিচল রয়েছেন।

যদিও যুদ্ধে রুশ বাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা অনকে বেশি এবং যতটা উচ্চাশা নিয়ে পুতিন ইউক্রেইনে আক্রমণ করেছিলেন বাস্তবে সেটা বেশ খানিকটা ধাক্কা খেয়েছে।

তারপরও পুতিনকে নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দারা যে মূল্যায়ন দিয়েছেন, সেটা এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, পুতিন বিশ্বাস করেন তাকে শাস্তি দিতে এবং রাশিয়ার ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করতে পশ্চিমারা যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে তাতে চিড় ধরবে।

তিনি বিশ্বাস করেন, চীন, ভারত এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সহায়তায় তিনি বাস্তবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াও এড়াতে পারবেন। ঠিক যেমনটি তিনি ২০১৪ সালে ইউক্রেইন থেকে ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ দখল করার পর পেরেছিলেন।

এছাড়া, রাশিয়া পরমাণু শক্তিধর দেশ। তাই তাদের বিরুদ্ধে সাবধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বাইডেন প্রশাসন এটা খুব ভালো করেই জানে।

ছবি: ইউটিউব ভিডিও

ছবি: ইউটিউব ভিডিও

বুধবার নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে পুতিন বলেছেন, যারা তার দেশকে ‘হুমকি দেয়ার চেষ্টা করছে এটা তাদের জন্য চিন্তার খোরাক জোগাবে’। ‘সারমাত’ নামের এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘বিশ্বসেরা’ বলেও দাবি করেন পুতিন।

বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়া যদি ক্ষেপণাস্ত্রটি মোতায়েনও করে তাতে তাদের সক্ষমতায় তেমন কোনও ফারাক পড়বে না। এখানে বরং মূখ্য বিষয় হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কোন সময়ে চালানো হয়েছে এবং তা কী বার্তা বহন করছে সেটি।

অনেকেই সতর্ক করে বলেছেন, যাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও রয়েছেন, সম্ভাবনা খুব সামান্য হলেও পুতিন হয়ত যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র এমনকি পরমাণু অস্ত্রও ব্যবহার করে ফেলতে পারেন।

পুতিনের আরেক অস্ত্র সাইবার হামলা। যদি পুতিন যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্রদের দিকে নজর দেন, অনুমান করা হয়, নিষেধাজ্ঞার বদলা নিতে রাশিয়া তার সাইবার হামলার অস্ত্রভাণ্ডার ব্যবহার করবে।

কিন্তু ইউক্রেইন যু্দ্ধ শুরুর পর আট সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। রাশিয়া এখন পর্যন্ত কোনও সাইবার হামলা করেনি। অথচ, যুক্তরাষ্ট্রের নেটওয়ার্কে রাশিয়ার সাইবার হামলা প্রায়ই দেখা যায়।

রাশিয়ার সাইবার হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আগেই ছয় মাসের জন্য তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সেবাখাত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ন্যাশনাল সাইবার পরিচালক ক্রিস ইঙ্গলিস বলেন, ‘‘যদি রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্ব, নেটো বা যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করে, সেটি একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত হবে, যা উভয় পক্ষের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে।”

তবে এতসব হুমকির পরও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হল, পুতিনের উপর চাপ বাড়ানো – অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা কিংবা ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী অস্ত্র সরবরাহ করা।

বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘ইউক্রেইন ইতিমধ্যে কিইভ এর যুদ্ধে জিতে গেছে।”

‘‘যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ইউক্রেইনকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে যাবে। যেন তারা জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে।”