দনবাসের দক্ষিণাংশে ইউক্রেইনের বন্দরনগরী মারিউপোলকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে রুশ বাহিনী এরইমধ্যে সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, কিন্তু ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনী সেখানে আত্মসমর্পণ করেনি।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই রাশিয়া বলে আসছিল, কিইভ দখল করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। রুশ বাহিনীর জেনারেল রুস্তম মিনেকায়েভ শুক্রবার বলেছেন, ইউক্রেইনের দক্ষিণাঞ্চলের পুরো নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে চান, কারণ তাতে মলদোভায় রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের সাথে মস্কোর যোগাযোগের পথ পরিষ্কার হবে।
ইউক্রেইনের দক্ষিণ-পূর্বাংশের ওই পুরোনো শিল্পকেন্দ্র দখল করে আসলে কী স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন? আদৌ সেটা সম্ভব? এক প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
দনেৎস্ক আর লুহানস্ক- এ দুই প্রদেশ মিলে দনবাস। এর একটি অংশে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আট বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ইউক্রেইনীয় বাহিনীর। তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত সেনারা সেখানেই নিয়োজিত।
যুদ্ধের গত দুই মাসে তাদের বড় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা, তবু রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য তারা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।
শুক্রবার খবর এসেছে, ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলে ৪০টির বেশি গ্রাম দখল করে নিয়েছে রুশ বাহিনী। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রুশ বাহিনীর ওই অগ্রযাত্রা কেবলই সাময়িক।

মারিউপোলের রাস্তায় রাশিয়ার একটি ট্যাঙ্ক। ছবি: রয়টার্স
পারবেন পুতিন?
বিবিসি লিখেছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন দনবাস এলাকার কথা বলেন, তিনি আসলে ইউক্রেইনের পুরোনো কয়লা ও ইস্পাত উৎপাদন অঞ্চলকেই বুঝিয়ে থাকেন।
ইউক্রেইনের পূর্বাংশের দুই বড় প্রদেশ লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকা বলতে দক্ষিণে মারিউপোল থেকে উত্তরে একদম রুশ সীমান্ত পর্যন্ত পুরো এলাকাকে দাবি করে থাকেন তিনি।
নেটোর ধারণা, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এখন ইউক্রেইনের দক্ষিণ উপকূল থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত একটি সংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের (রুসি) স্যাম ক্র্যানি-ইভানস বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, ক্রেমলিন ওই অঞ্চলটিকে রুশ-ভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ধারণা করে নিয়েছে যে ইউক্রেইনের রুশ-ভাষী অংশের নাগরিকরা অনেক বেশি রুশপন্থি।”
রোচান কনসালটিংয়ের প্রধান কনরাড মুজিকা বলেন, ওই অঞ্চল রুশভাষী অধ্যুষিত হলেও তারা এখন আর রুশপন্থি নেই।
“মারিউপোল ইউক্রেইনের অন্যতম রুশপন্থি শহর হিসেবে পরিচিত ছিল একসময়। এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে এর তুলনা করার ভাষা আমার জানা নেই।”
যুদ্ধ শুরুর এক মাস পর এসে রাশিয়া দাবি করে, তারা লুহানস্কের ৯৩ শতাংশ এবং দোনেৎস্কের ৫৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পেতে রুশ প্রেসিডেন্টকে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তাতে যদি তিনি বিজয়ী হতেও পারেন, নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য ওই অঞ্চলটি অনেকটাই বড়।
কেন দনবাস
ভ্লাদিমির পুতিন বারবারই দাবি করে আসছেন, ইউক্রেইনের পূর্বাংশে দনবাস গণহত্যা চালানো হয়েছে, যদিও এর পক্ষে এ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি।
যুদ্ধ শুরুর সময় দনবাস অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউক্রেইনের কাছে। বাকি অংশটি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে। যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে পুরো দনবাস অঞ্চলকে স্বাধীন দুটি রষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ক্রেমলিন।
বিবিসি লিখেছে, যদি রুশ সেনারা এই দুটি বড় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য তা এই যুদ্ধ থেকে কিছু প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। পরের পদক্ষেপটি হতে পারে দনবাসকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করা, যেমনটি করা হয়েছে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে।
এবং যদি ৯ মের আগে এই বিজয় অর্জিত হয়, তাহলে পুতিন একে বিজয় দিবসে উদযাপনও করতে পারবেন। ১৯৪৫ সালের ৯ মে রুশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী জার্মানিকে পরাজিত করে এবং দিনটিকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ‘ভিকটোরি ডে’ বা ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে উদযাপন করে আসছে।
লুহানস্কে ‘রাশিয়ার পাপেট’ নেতা এরইমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে’ তারা একটি গণভোটের আয়োজন করতে চান।

পুতিনের কৌশলটি কী?
বিবিসি লিখেছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পূর্বাঞ্চলে থাকা ইউক্রেইনের বাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে, তারা উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিংস কলেজ লন্ডনের সংঘাত ও নিরাপত্তা বিভাগের অধ্যাপক ট্রেসি জার্মান বলেন, “নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এটা অনেক বড় একটি এলাকা, এবং আমার মতে, এর ভৌগলিক জটিলতার বিষয়টিকে খাটো করে দেখা উচিত হবে না।”
প্রায় দুই মাস লড়েও ইউক্রেইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ দখলে নিতে পারেনি রুশরা। তবে তারা ইজিউমের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর।
অধ্যাপক জার্মান বলেন, “আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে রুশ সেনারা ইজিউম ঘিরে কী করছে, দেখবেন শহরটি সেদেশের মূল মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত এবং রুশ বাহিনীর বেশিরভাগ সামরিক সরঞ্জাম রেল ও সড়ক পথে পরিবহনের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।”
বিবিসি লিখেছে, রুশদের পরের বড় লক্ষ্যটি হল স্লোভিয়ানস্ক শহর। সোয়া লাখ বাসিন্দার এ শহরটি ২০১৪ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল, পরে তা পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেনীয়রা। এর কিছুটা দক্ষিণেই ক্রামাতোরস্ক শহরের দখল নেওয়া আরেকটি বড় লক্ষ্য তাদের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলছে, যদি ইউক্রেইন স্লোভিয়ানস্কের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে, তাহলে লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চল দখলে রাশিয়ার অভিযান ‘সম্ভবত ব্যর্থ হবে’।
এই শহরগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পশ্চিম অভিমুখী অভিযান চালাতে পারবে এবং ইজিউম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হতে চাওয়া রুশ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হতে পারবে।
এই লক্ষ্য অর্জন করতে রসদ সরবরাহের পথ উন্মুক্ত রাখার জন্য সড়ক পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে রুশদের এবং পশ্চিম থেকে আসা রেলপথে ইউক্রেইনীয়দের প্রবেশ আটকে দিতে হবে।
ইউক্রেনীয় সেনাদের কাছে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌঁছানো এবং সাধারণ ইউক্রেইনীয়দের দ্রুত পালানোর সবচেয়ে কার্যকর পরিবহন হচ্ছে ট্রেন। রেলপথের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলেই রুশরা তাদের সেনা ও সরঞ্জাম স্থানান্তরে সুবিধা পাবে।
ইউক্রেইনের সেনারা টিকতে পারবে?
যুদ্ধের শুরুতে, ইউক্রেইনের পূর্বাংশে ১০টি ব্রিগেড নিয়ে গঠন করা হয় জয়েন্ট ফোর্সেস অপারেশন (জেএফও)। ধারণা করা হয়, এরাই ইউক্রেইনের সবচেয়ে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেনা।
রুসি-র স্যাম ক্র্যানি-ইভানস বলেন, বর্তমানে ইউক্রেইনের বাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তিনি মনে করেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় সেনা সংখ্যা বেড়েছে।
রোচান কনসালটিংয়ের কনরাড মুজিকা বলেন, রাশিয়ার বাহিনী সাত সপ্তাহের যুদ্ধে এরই মধ্যে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং তাদের মনোবলও দুর্বল হয়ে গেছে। মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সীমান্তবর্তী রুশ সেনাদের নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি বলেন, “ইউক্রেনীয়দের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রুশ বাহিনীর যতটা বেশি সম্ভব ক্ষতি করা এবং সেজন্য তারা বড় যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ও অপ্রচলিত কৌশল ব্যবহার করছে।”