দেহের অতিরিক্ত ওজন কমানো কষ্টকর। প্রথমদিকে কয়েক কেজি
কমলেও চোখে পড়ে না পরিবর্তন। তবে শরীরের ভেতরের পরিবর্তনগুলো ঠিকই ঘটতে শুরু করে।
তাই ওজন কমানোর চেষ্টায় প্রাথমিক অবস্থাতেই যাতে উৎসাহ
না হারিয়ে ফেলেন সে কারণে জেনে নিন পরিবর্তনগুলো।
চর্বির কোষ
সঙ্কুচিত হয়
খরচের চাইতে কম ক্যালরি গ্রহণের ফলে দেহ বাড়তি শক্তির যোগান
নেয় চর্বি থেকে। ফলে চর্বির স্তর সঙ্কুচিত হওয়া শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউরো কফি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডা. মাইক রাসেল
ইটদিস ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেন, “খাবার থেকে পর্যাপ্ত শক্তি না পাওয়ার
ফলে দেহ যখন চর্বির কোষ থেকে শক্তির চাহিদা মেটাতে শুরু করে তখনই চর্বির স্তর সঙ্কুচিত
হতে থাকে।”
আবার উল্টা বিষয়ও ঘটে বলেন জানান এই চিকিৎসক।
“হতাশ হয়ে প্রাথমিক অবস্থাতেই ওজন কমানোর কার্যক্রম বন্ধ
করে দিলে শরীর আবার চর্বি জমাতে শুরু করে আরও দ্বিগুন হারে।”
তাই যারা ওজন কমানোর চেষ্টা ছেড়ে দেন, তাদের ওজন দ্রুত
বাড়তে থাকে।
রক্তে শর্করার
মাত্রা ঠিক থাকা
কয়েক কেজি কমার মানে হল রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে
দেহকে সাহায্য করা।
ডা. রাসেল বলেন, “কম খাওয়া আর বেশি কর্মক্ষম থাকার ফলে
ইন্সুলিনের সংবেদশীলতা বাড়তে থাকে। ফলে রক্তের শর্করার মাত্রা দেহ আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ
করতে পারে।”
আর রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে অতিরিক্ত খিদা
লাগার হাত থেকেও বাঁচা যায়।
প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ
যদিও প্রদাহ শরীরের একটা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
তবে অতিরিক্ত ওজনের ফলে অতিরিক্ত প্রদাহ হয় যা থেকে নানান দীর্ঘমেয়াদী রোগ হওয়ার সম্ভাবনা
থাকে। যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার।
নিউট্রিশন রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত কোরিয়ার ‘সিউল ন্যাশনাল
ইউনিভার্সিটি’র করা গবেষণার ফলাফল বলে, গড়ে ছয় পাউন্ড বা আড়াই কেজি কমার ফলে ‘প্রো-ইনফ্লামাটোরি
প্রোটিন’ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, ফলে প্রদাহ কমে। আর এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও
ভূমিকা রাখে।
বিপাকীয় কার্যক্রমের
পরিবর্তন
ক্যালোরি পোড়ানোর কার্যক্রম নির্ভর করে বিপাকীয় ক্ষমতার
ওপর। অর্থাৎ খাবার খাওয়ার পর থেকে সেটা বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে কোষে পৌঁছানো
আর শক্তি যোগানো ও খরচ করার পুরোটাই বিপাকীয় কার্যক্রমের আওতায় পড়ে।
ডা. রাসেল বলেন, “ওজন কমার সঙ্গে সঙ্গে বিপাকীয় কার্যক্রমও
ধীর হয়। কারণ আগের চাইতে শরীরে কম ক্যালরির প্রয়োজন হচ্ছে। ক্যালরি গ্রহণ কমানো আর
ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ানো ফলাফল এরকমই হয়। আর
ধীর বিপাকীয় কার্যক্রম মানে শরীরে নেতিবাচক প্র্রভাব পড়ে কম।”
হাড়ের সংযোগে
স্বস্তি
ওজন বেশি মানেই হাড়ের ওপর চাপ বেশি। এটাই স্বাভাবিক। অতিরিক্ত
ওজন হাড়ের চাপ বাড়ায় ফলে হাড়ক্ষয় রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে। দেহে কয়েক কেজি কমা মানে
হাড়ের ওপরেও কয়েক কেজি চাপ কম পড়া।
বাজে চর্বির
মাত্রা কম
সেল মেটাবোলিজম’ সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি
স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের করা গবেষণা থেকে জানা যায়, মাত্র কয়েক কেজি কমার ফলে শুধু ‘লিভার
ফ্যাট’ নয় পাশাপাশি ‘ইন্ট্রা-অ্যাবডোমিনাল ফ্যাট’ও কমে।
এই চর্বি অন্ত্রের গায়ে জড়িয়ে থাকে এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর
অনু নিঃসরণ ঘটায় যা থেকে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
এই ‘ইন্ট্রা-অ্যাবডোমিনাল ফ্যাট’ কমার ফলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমে।
সুস্থ হৃদযন্ত্র
ওজন কমার ফলে বাড়ে ‘এইচডিএল কোলেস্টেরল’, যা কিনা ভালো
কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত। আর খারাপ কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত ট্রাইগ্লিসারাইড কমতে
থাকে। ফলে কমে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা।
জার্নাল অফ দ্যা আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’য়ে প্রকাশিত
প্র্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থূল ও অতিরিক্ত ওজনের নারীদের মধ্যে যারা ওজন কমিয়েছেন, দুই
বছরের মধ্য তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমেছে।
আরও কর্মক্ষম
হওয়া
শরীরটাই এরকম। বেশি খাটালে বেশি কাজ করবে। আর আলসেমি করলে
শরীরও ঢিলে হবে। ক্যালরিও খরচ কমে যাবে।
তাই ব্যায়াম যত কমই করা হোক, শারীরিক কসরতের মধ্যে থাকলে
শরীরের কর্মক্ষমতা বাড়তে থাকে।
ডা. রাসেলের ভাষায়, “ওজন কমার ফলে পেশি আরও কর্মক্ষম হয়ে
উঠবে। যত দৌঁড়াবেন বা হাঁটবেন ততই ক্যালরি খরচ হবে, এমনকি সেটা প্রতিদিন একই দূরত্বের
হলেও।
ঘুম ভালো হবে
ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া’র করা গবেষণা বলে, সামান্য
ওজন কমাতে পারলেও উন্নত ঘুম হয়। এর মানে প্রফুল্ল মন আর বেশি এনার্জি।
দেহের পানির
ওজন কমা
সাধারণত ওজন কমার প্রাথমিক পর্যায়ে দেহ থেকে প্রথমে পানির
ওজন কমে। তবে সেটা আবার নির্ভর করে কোন ধরনের খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা হচ্ছে সেটার ওপর।
“যদি কার্বোহাইড্রেইট কমিয়ে খাদ্যাভ্যাসের দিকে যাওয়া হয়
তবে ওজন কমার ফলে পেশিতে কার্বোহাইড্রেইটের সঙ্গে জমে থাকা পানিও কমবে,” বলেন ডা. রাসেল।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “যখন কার্বোহাইড্রেইট খরচ করা হবে
অথচ পূরণ করা হবে না তখনই এই ঘটনা ঘটবে। তবে পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি যদি সেভাবে
ক্যালরি বা কার্বোহাইড্রেইট গ্রহণের মাত্রা কমানো না হয় তবে দেহের চর্বি বেশি কমবে।”
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
অতিরিক্ত ওজন মানেই হৃদপিণ্ডকে বেশি মাত্রায় রক্ত প্রবাহ
করতে হচ্ছে। যার মানে উচ্চ রক্তচাপ।
‘ডায়াবেটিস কেয়ার’ সাময়িকীতে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের রোড
আইল্যান্ডে’র ব্রাউন মেডিকেল স্কুল, দি মিরিয়াম হসপিটাল’য়ের করা গবেষণা অনুসারে, যারা
অতিরিক্ত ওজনের এবং টাইপ টু ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের সামান্য ওজন কমানোর ফলে রক্তচাপের
মাত্রাও কমে।
প্রফুল্ল মন
ওজন কমানোর যাত্রার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলেও দুই আড়াই কেজি
কমার মাধ্যমে মনও হবে চাঙ্গা।
সায়েন্সডাইরেক্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘জেমস কুক ইউনিভার্সিটি
অস্ট্রেলিয়া’র করা গবেষণার ফলাফল অনুসারে, যারা মাত্র কয়েক পাউন্ড ওজন কমিয়েছেন তাদের
মাঝে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গেছে।
তাই ওজন কমানোর চেষ্টায় যদি স্কেলের কাঁটা খুব একটা নাও
নড়ে তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার এই পরিবর্তনের প্রভাব ভেতরে
যা ঘটাচ্ছে তা বাইরে প্রকাশি পেতে বেশিদিন লাগবে না।
আরও পড়ুন