চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী সপ্তাহে ৩ মে হতে পারে রোজার ঈদ। তার আগে আগামী বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হবে ঈদযাত্রা, কেননা সাপ্তাহিক ছুটি আর মে দিবসের ছুটি এবার মিলে যাচ্ছে ঈদের ছুটির সঙ্গে।
ঈদে প্রধান প্রধান মহাসড়কগুলোতে বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও পরিবহন সামলাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সড়ক বিভাগ বললেও তাতে আস্থা পাচ্ছে না বড় পরিবহনগুলোর মালিকেরা।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পরিবহন কোম্পানি হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. কফিলউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এবার ট্রিপ কমিয়ে দিয়েছি। যে রুটে ১০টি ট্রিপ ছিল, সে রুটে আমরা গড়ে সাতটি করে বাসের টিকিট বিক্রি করছি। তিনটি করে গাড়ি হাতে রাখছি আমরা।”
“আমাদের যাত্রীদের দুর্ভোগ ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম ধরে রাখতে আমরা এ ব্যবস্থা নিচ্ছি,” বলেন তিনি।
কল্যাণপুর, গাবতলীসহ বিভিন্ন বাসের কাউন্টারে খবর নিয়ে জানা যায়, নিয়মিত ট্রিপের চেয়ে ঈদের ট্রিপ কমিয়ে দিয়েছেন প্রায় সবাই।
পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সড়কের পরিস্থিতি দেখেই এই পদক্ষেপ নিচ্ছেন বাস মালিকরা।
তিনি বলেন, “শ্যামলী পরিবহনের ৪৯ বছর হয়ে গেল। এই ৪৯ বছরে আমরা ৯৮টি ঈদ পার করেছি। এই সমস্ত উৎসব পার্বনে আমরা সব গাড়ি বুক দিই না। অন্তত ১০ শতাংশ গাড়ি হাতে রাখি।
“একটা গাড়ি নষ্ট হলে বা যানজটে আটকে গেলেও যাতে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করা যায়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা রাখে বড় বড় সব কোম্পানিই।”
ঈদযাত্রা: সড়কে অনেক প্রস্তুতি, তবুও শঙ্কা

সংস্কার শেষে একটি বাসে নতুন সিট বসানো হয়েছে। ছবিটি গাবতলীর একটি গাড়ি মেরামত কারখানার। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
ছোটখাট যেসব কোম্পানি নিজেদের সব বাস ট্রিপের জন্য রাখে, তারা বিপদে পড়ে বলে অভিজ্ঞতা থেকে বলেন রমেশ।
ঈদের সময় গজিয়ে ওঠা এমন কিছু পরিবহন কোম্পানির হাঁকডাক দেখা গেল কল্যাণপুরে। নিয়মিত রুটে তাদের বাস না থাকলেও বিভিন্ন নামের ‘স্পেশাল সার্ভিসের’ কথা বলে টিকেট বিক্রি করছে তারা। এদের কোনো কাউন্টার নেই, টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে টিকেট বিক্রি করছে তারা।
বৈশাখী নামের এমন একটি ‘স্পেশাল সার্ভিস’র টিকিট বিক্রিতে থাকা মো. জাকারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলার পথে তাদের বাস ছেড়ে যাবে ঈদের আগে।
কথা বলে জানা গেল, ঢাকার মধ্যে স্বল্প দূরত্বে চলাচল করা বাসগুলো ভাড়া নিয়ে তারা দূরপাল্লায় চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঢাকা-সাভার রুটের ঠিকানা পরিবহনের একটি বাসের কন্ডাক্টর মো. কামরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, উত্তরাঞ্চলের পথে যাওয়ার জন্য তারা এর মধ্যেই ২৭ হাজার টাকায় একটি আপ-ডাউনের বুকিং পেয়েছেন। এক ট্রিপ দিয়ে ফিরলে আবার যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এজন্য বাসের গিয়ারবক্স, রেডিয়েটর, ব্রেকের কাজ করানো হয়েছে, টায়ারও বদলানো হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ঘুরে দেখা যায়, সিটি সার্ভিসের বাসগুলো মেরামত হচ্ছে, বহিরাবরণে রঙ লাগানো হচ্ছে।
দূর পাল্লায় চলার জন্য বাসগুলোকে তৈরি করা হচ্ছে বলে ওয়ার্কশপের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

বাসে লেখা গুলিস্তান-শাহবাগ-ফার্মগেট, মানে এটি সিটি সার্ভিসের বাস। কিন্তু ঈদের আগে মেরামত করে এগুলো ছুটবে দূরের যাত্রী নিয়ে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
এসব লোকাল বাসের কারণে ঈদের সময় সড়কে যানজট সৃষ্টি হয় বলে দাবি করেন হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক কফিলউদ্দিন।
তিনি বলেন, “দূরপাল্লায় চলার অযোগ্য এসব বাস যেখানে-সেখানে নষ্ট হয়, আবার দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ায়। এই গাড়িগুলোকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দুর্ভোগ কিছুটা কমে।”
শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষও বলেন, “লোকাল বাসগুলো প্রতিবারই দূরপাল্লায় গিয়ে গোল বাঁধায়। বাসগুলো দেখতে চকচকে হলেও এদের দূরপাল্লার অভিজ্ঞ চালক যেমন নেই, তেমনি গাড়িগুলোও একটানা চলার মতো উপযুক্ত নয়। এই গাড়িগুলো যেন নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেটা আমরা বলেছি।”
এবারের রোজার ঈদের সময় প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ গ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বে বলে ধারণা পাওয়া গেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক জরিপে।
এই বিপুল সংখ্যক যাত্রীর চাপ সামলানো বড় পরিবহন কোম্পানিগুলোর পক্ষে সম্ভবপর নয়। ফলে স্বল্পপাল্লার বাসগুলোর বিকল্পও থাকছে না।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “একসঙ্গে যখন গার্মেন্টস ছুটি হয়, তখন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তখন টঙ্গীর কোনো মোড় থেকে (ত্রুটিপূর্ণ) গাড়ি ছাড়ছে, ট্রাকে করে যাচ্ছে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কঠোর থাকতে পারে না, মানবিক একটা অ্যাপিলও সৃষ্টি হয়ে যায়।”
ঈদের সময় প্রতিদিন ঢাকা ছাড়বে ৩০ লাখ মানুষ: জরিপ

আজমেরী গ্লোরী রাজধানীর সদরঘাট থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চলাচল করে। ঈদের সময় এই বাসগুলো পাওয়া যাবে না এই রুটে, কারণ তখন এগুলো দূরের যাত্রী টানবে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
গার্মেন্টে একযোগে ছুটিতে বাড়তি চাপ
দেশের ৪০ লাখের বেশি পোশাক শ্রমিকের অধিকাংশের কর্মস্থল ঢাকা এবং এর আশপাশের গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এলাকা।
বৃহস্পতিবার পোশাক কারখানাগুলোতে একযোগে ছুটি হবে বলে সড়কে বাড়তি চাপে অব্যবস্থাপনা এবং যাত্রীদের ভোগান্তির শঙ্কা করছেন পরিবহন মালিকরা।
সাভার, জয়দেবপুর, আশুলিয়া, চন্দ্রা এলাকার পোশাক শ্রমিকরা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে ঈদের সময় যেতে দল বেঁধে বাস ভাড়া করেন। এসব বাসের অধিকাংশই রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী।
গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় এসব বাস ভাড়ার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা মো. ইসমাঈল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২৮ এপ্রিল রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রামে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে যেতে তিনি এর মধ্যেই নয়টি গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন।
ইসমাঈল যে গাড়িগুলো ভাড়া আনছেন, সেগুলো মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে স্বল্প দূরত্বে চলাচল করে।
বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার বিআরটিএতে এক বৈঠকে তারা সব পোশাক কারখানায় ছুটি এক দিনে না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
“কিন্তু আমরা শুনছি ঢাকা ও আশপাশের সব গার্মেন্টস একেযোগে ২৮ এপ্রিল ছুটি হচ্ছে। ওই লোকগুলো যখন সন্ধ্যা বেলায় একযোগে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াবে, তখন তো রাস্তাটা এমনিতেই কলাপস করবে।”

ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কাজলার সামাদনগরে বাস মেরামতের ওয়ার্কশপে চলছে সিটি সার্ভিসের বাস মেরামতের কাজ। ঈদের সময় এই বাসগুলো দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন করবে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
পরিবহন মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা ট্রান্সপোর্টের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহও পোশাক কারখানার একযোগে ছুটি হওয়া নিয়ে শঙ্কিত।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গার্মেন্টসগুলো যদি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ছুটিটা দিত, তাহলে একসাথে চাপটা পড়তে না। আমরা বলেছি ভিন্ন ভিন্ন ডেটে ছুটি দেওয়ার জন্য। যেমন: গাজীপুরের দিকের কারখানাগুলো একদিনে, মিরপুরের দিকেরগুলো আরেক ডেটে, নারায়ণগঞ্জকেন্দ্রিক কারখানাগুলো ভিন্ন ডেটে ছুটি দেওয়ার জন্য।”
গত ১১ এপ্রিল শ্রমভবনে এক সভায় শ্রমিকদের ছুটির বিষয়টি উঠলেও মতৈক্য না হওয়ায় কোনো তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়নি। সভায় পোশাক মালিক-শ্রমিক ও সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক পরিষদ (টিসিসি) এবং আরএমজি বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেছিলেন, সরকারি ছুটি অনুযায়ী শ্রমিকদের ঈদের ছুটি হবে।এর বাইরে মালিক শ্রমিক প্রতিনিধিরা পারস্পরিক আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে ছুটি বাড়াতে পারবেন।
এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এবার ঈদযাত্রায় সড়কে বেশি চাপের আশঙ্কার পাশাপাশি চাপ সামলাতে ‘সব’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।