ক্যাটাগরি

মজুদ বাড়াতে রপ্তানিতে বিধিনিষেধ, বিশ্ববাজারে আরো চড়ছে দাম

গত দুই বছর ধরে মহামারীর ধাক্কায় বিশ্ববাজারের অবস্থা এমনতেই নাজুক হয়ে পড়েছিল। তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এখন ইউক্রেইন যুদ্ধের জের।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ‍অর্থনীতিকে সামাল দিতে ইউক্রেইন সূর্যমুখী তেল, গম, ওটস এবং গবাদিপশু রপ্তানি সীমিত করেছে। রাশিয়া অন্য দেশের কাছে সার, চিনি ও শস্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে।

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি পাম অয়েল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়া। নিজেদের বাজার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে দেশটি সবথেকে বেশি ব্যবহৃত ভোজ্যতেল পাম অয়েল রপ্তানি স্থগিত করেছে। তুরস্ক বন্ধ করেছে বাটার, গরুর মাংস, ভেড়া, ছাগল, ভুট্টা এবং ভোজ্য তেল রপ্তানি।

ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে সুরক্ষাবাদের একটি নতুন ধারাকে উন্মচিত করেছে। পণ্যের সংকট এবং ক্রমবর্ধমান দামের কারণে সরকার নিজ নিজ নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে মরিয়া হয়ে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানিতে বাধা দিতে নানা প্রতিবন্ধকতা আরোপ করছে।

বেশিরভাগ সময় এই ব্যবস্থা ভালো উদ্দেশে নেওয়া হয়। কিন্তু বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মহামারীর দুই বছরে বিভিন্ন সময় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটার মাধ্যমে যেভাবে দোকানের তাক খালি করে ফেলেছিল, সুরক্ষাবাদের বর্তমান ধারা কেবল ওই সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তুলবে। অথচ, মহামারীর ধাক্কা সামলে বিভিন্ন দেশের সরকার ওই সমস্যাগুলো কামিয়ে আনার চেষ্টা করছিল।

রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে শস্য, তেল, মাংস এবং সারের দাম এরইমধ্যে রেকর্ড ছুঁয়েছে।  এটি বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের উপর আরও বেশি বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে, যারা খাদ্যের জন্য তাদের আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করেন। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে লড়াই করতে থাকা দরিদ্র দেশগুলিতে সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।

এ বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন দেশ খাদ্যপণ্য এবং সারের উপর মোট ৪৭টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারমধ্যে ৪৩টি আরোপ করা হয় রাশিয়া ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরুর পর। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া।

অধ্যাপক সায়মন ইভেনেট নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এ তথ্য দিয়ে বলেন, ‘‘আগ্রাসন শুরুর আগে খাদ্যপণ্য এবং সার রপ্তানিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে অল্প কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর সেটা অনেক বেড়ে গেছে।”

ইউক্রেইন যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে একের পর এক বাধা আসতে শুরু করে। এদিকে রাশিয়াকে আটকাতে দেশটির উপর পশ্চিমাদের একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও বিশ্বজুড়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক ধাক্কা হয়ে এসেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আগেই যেটি নাজুক অবস্থায় ছিল।

রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম, অপরিশোধিত লোহা, নিকেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। দেশটি বিশ্বে কয়লা, অপরিশোধিত তেল এবং সারের প্রধান সরবরাহকারীদের অন্যতম।

অন্যদিকে, ইউক্রেইন সূর্যমুখী তেলের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক এবং গম, অপরিশোধিত লোহা, ভুট্টা এবং বার্লির বড় রপ্তানিকারক দেশ।

বিশ্বজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‍অনেক নীতিনির্ধারক দ্রুত খোলা বাজার নীতির ভাষা ত্যাগ করে সুরক্ষামূলক নীতির পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন।

তারা মিত্রদেশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের জন্য সুরক্ষিত সরবরাহ চেইন তৈরি করা থেকে শুরু করে রপ্তানি বন্ধ করা এবং বিদেশি কারখানাগুলিকে ‘পুনরায় সংরক্ষিত’ করা এবং তাদের নিজদেশে কার্যক্রম ফিরিয়ে আনার মত সুপারিশ করছেন।

দেশগুলোকে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা।

গত বুধবার এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিকভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা কতটা যুক্তিযুক্ত? ইউক্রেইন যুদ্ধ ‘ন্যায়সঙ্গতভাবেই’ এই প্রশ্ন সবার সমানে নিয়ে এসেছে।

তিনি একইসঙ্গে দেশগুলিকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্তে না আসার আহ্বানও জানিয়ে। বলেছিলেন, বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাই বিশ্বকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করেছে এবং মহামারী চলাকালীন সময়েও বিভিন্ন দেশকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সরবরাহ করে গেছে।

‘‘যদিও এটা সত্য যে, (যুদ্ধের কারণে) বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হতে পারে, আর সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় ‍রাখতে বাণিজ্য ব্যবস্থা ঠিক রাখাটা জরুরি।”

সেই কোভিড মহামারীর শুরু থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দেশগুলোক রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কোভিড মহামারী যখন শুরু হয় তখন এমনকি যুক্তরষ্ট্রের মত দেশও মাস্ক এবং ওষুধ রপ্তানিতে ‍নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। পরে খুব ধীরে ধীরে তারা ওইসব বিধিনিষেধ তুলে নেয়।

এখন ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর খাদ্যপণ্যের উপর একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঢেউ আসছে। ‘এটা ‍অনেকটা অতীতকে ফিরিয়ে আনার’ মত বলেছেন এভেনেট।