দেড় বছর ধরে চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার একটি জেটিতে ঘাট শ্রমিক হিসেবে এমন হাড়ভাঙা খাটুনির দিন পার করছেন ভোলার চরফ্যাশনের বাসিন্দা মোহাম্মদ সজীব।
ঘাটে দাঁড়ানো জাহাজ থেকে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ বস্তা মালামাল মাথায় করে নামিয়ে ট্রাকে তুলে পান সাত থেকে আটশ টাকা। দিনে দুইবেলা ভাত আর তিনবেলা নাস্তা মিলে খরচ আড়াই থেকে তিনশ টাকা।
বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মাসহ তিন ভাইয়ের সংসার। সামান্য এই আয় থেকে জমিয়ে প্রতি সপ্তাহে তাকে বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। জমার খাতা তাই অনেকটাই শূন্য।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ভোলা থেকে কাজের সন্ধানে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এসেছেন ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্নে। সদরঘাট এলাকায় পরিচিতদের সহায়তায় লেগে পড়েন ঘাট শ্রমিকের কাজে।
শনিবার দুপুরে নগরীর সদরঘাট এলাকার একটি ঘাটে কথা হয় সজীবের সঙ্গে। দুপুরের তপ্ত রোদে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। আলাপে উঠে আসে তার সংগ্রামের গল্প আর অনাগত এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
ঈদে সবাই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেও সজীবসহ তার মতো অনেকেই বাড়ির পথ ধরবেন না। এই সময়টায় বাড়ি যেতে খরচ বেশি হওয়ায় পরে কোনো এক সময় তারা বাড়ি যাবেন।
কিছুটা বাড়তি আয়ের আশায় এবার তিনি আরও বাড়তি খাটতে চান। সজীবের কাছে ঈদের দিনটি কোনো উৎসব হয়ে আসে না, প্রতিটি দিনই কেবল বেঁচে থাকার লড়াই।
শ্রমিকদের জন্য আলাদা দিন থাকলেও এ নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। সজীবের কাছে মে দিবস আর সব দিনের মতোই প্রাণান্ত পরিশ্রমে ঘামে ভেজা একটি দিন।
“আমাদের জন্য দিন আছে জানি, কিন্তু তাতে কি আসে যায়। আমাদের পেটচিন্তা নিয়ে থাকতে হয়।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সজীব বলেন, “আমরা বিভিন্ন পণ্যের বস্তা জাহাজ থেকে ট্রাকে তুলে থাকি। ৯০ কেজির বস্তায় সাত টাকা আর ৬০ কেজির বস্তায় তিন টাকা করে মজুরি পাই।”
তার হিসেবে, প্রতিদিন গড়ে একজন শ্রমিক দুইশ থেকে আড়াইশ বস্তা নামায়। এতে সাত থেকে আটশ টাকার মতো রোজগার হয়। তবে কোনোদিন বেশি কাজ করলে তা হাজার থেকে দেড় হাজার পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
“কোনো সময় অসুস্থ থাকলে কাজ করতে পারি না। কাজও মেলে না কোনো দিন। প্রতিমাসে ২০ থেকে ২২ দিন আমরা কাজ পাই। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো আয় হয় মাস শেষে।”
এ রোজগার থেকে পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পাঠাতে হয়। বাবা-মায়ের ওষুধ খরচ, ঘর খরচ মিলিয়ে তার রোজগারের প্রায় সব অর্থ খরচ হয়ে যায়।
তারপরও বাড়তি শ্রম দিয়ে বাড়তি রোজগার থেকে প্রতিমাসে কিছু সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন সজীব। কিছু টাকা জমা রাখেন ঘাটের এক মাঝির কাছে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বাসিন্দা কালাম হাওলাদার ও জাকিয়া বেগমের চার ছেলের মধ্যে সবার ছোট সজীব। দারিদ্র্যের মধ্যে অনেক কষ্টে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন।
বড় তিন ভাইয়ের মধ্যে দুজন একসময় বিদেশে থাকলেও মহামারীর সময় কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ভাগ্য ফেরাতে সজীব চট্টগ্রাম এসেও কোনো কাজ পাচ্ছিলেন না।
চাচা ঘাট-গুদাম শ্রমিকদের মাঝি হবার সুবাদে দেড় বছর আগে বিভিন্ন ঘাটে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন সজীব। শুরুর দিকে কাজ কম মিললেও এখন কাজ বেশি।
এত পরিশ্রমের পরও সজীবের মুখে দেখা দেয় হাসি। আর পাঁচ বছর কাজ করে ফিরে যেতে চান ভোলার চরফ্যাশনে নিজ গ্রামে। টাকা জমিয়ে একটি গরুর খামার দেওয়ার ইচ্ছা তার।
সজীব বলেন, ‘‘শ্রমিকের জীবনে খাটুনি অনেক বেশি। ডেইলি কাজ করে শরীরে আর বল থাকে না। টাকা জমাতে পারলে বাড়িতে গিয়ে গরুর খামার দিব। সেটা দিয়ে ঘর চলবে। টাকা জমাতে পারলে এটা করা সম্ভব। খামার দিতে পারলে বিয়ে করব।’’
ঘাট শ্রমিকের কাজে ঝুঁকির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “জাহাজ থেকে বস্তা নামাতে গিয়ে কখন নদীতে পড়ে যাই তার ঠিক নাই। কতজন পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে।
“মাঝে মাঝে ভয় লাগে, মজুরিও পরিশ্রমের তুলনায় কম। সেকারণে একটা সময় গিয়ে বস্তা তোলার কাজ ছেড়ে দিতে চাই।”
চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে মাঝিরঘাট পযর্ন্ত কর্ণফুলী নদীর তীরে ঘাট আছে ১৬টি। এসব ঘাটে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো নামানোর সঙ্গে যুক্ত দুই হাজারের মতো শ্রমিক।