ক্যাটাগরি

পাঞ্জাবির পোয়াবারো, মন্দা শাড়ির বাজারে

সময়ের পরিক্রমায় এ অঞ্চলে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদের নামাজে অত্যাবশকীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে পাঞ্জাবি। ফ্যাশন হাউজ, সাধারণ দোকান কিংবা ব্র্যান্ডের শোরুম- সব জায়গাতেই তরুণ, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধদের আগ্রহ পাঞ্জাবি ঘিরেই। এবার ঈদ গরমে পড়ায় চাহিদা বেশি সুতি পাঞ্জাবির।

গেল কয়েক বছরের মত এবারও ঈদ ফ্যাশনে শাড়ির চাহিদা কম দেখা গেছে। শাড়ির ক্রেতাদের বড় অংশকে বিপণিবিতানগুলোতে ঘুরতে দেখা গেছে মূলত বয়স্কদের জন্য উপহার কিংবা জাকাতের জন্য।

গত চারদিন রাজধানীর মিরপুর, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মল, নিউ মার্কেট ও এলিফ্যান্ট রোডের বিপণিবিতান ঘুরে দেখা যায়, পাঞ্জাবির বিক্রি অন্য পোশাককে ছাড়িয়ে গেছে। এরপর বিক্রি হচ্ছে ক্যাজুয়াল শার্ট, জিন্স ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট এবং ফতুয়া।

যমুনা ফিউচার পার্কে পোশাক ব্র্যান্ড ইয়োলোর ব্যবস্থাপক কে এম রিদওয়ান শিফো জানান, সেখানে পাঞ্জাবি বেশি বিক্রি হচ্ছে। এরপর রয়েছে কাবলি। আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার পাঞ্জাবি বেশি বিক্রি হচ্ছে।

“তিন হাজার টাকার উপরের পাঞ্জাবির বিক্রি কম। অন্যবার টি-শার্টও বেশি বিক্রি হত, এবার এটার চাহিদাটা কম।”

একই শপিংমলের ‘নবরূপা’য় দেখা যায়, গরমে আরামদায়ক সুতি কাপড়ের সাদা পাঞ্জাবিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; রয়েছে মেশিনে অ্যাম্বুশ করা কাজ আর গলায় কাজ।

শাখা ব্যবস্থাপক সোহেল হোসেন জানালেন, ঈদ উপলক্ষে পাঁচশর বেশি মডেলের পাঞ্জাবি রেখেছেন তারা।

“নববর্ষ ও গরমে ঈদের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সাদা পাঞ্জাবি এনেছিলাম বেশি। করোনার কারণে এবার দাম দুই হাজারের মধ্যে রাখা হয়েছে। এ কারণে পাঞ্জাবির বিক্রি অনেক বেশি হচ্ছে।”

তবে বাচ্চাদের পাঞ্জাবির অনেক কালেকশন থাকলেও বিক্রি কম হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বসুন্ধরার দর্জিবাড়ির ব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ জানান, তাদের সব পণ্যের মধ্যে পাঞ্জাবিই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। তরুণদের ক্যাজুয়াল পাঞ্জাবি বেশি বিক্রি হচ্ছে; সেমি ফিট ২ হাজার ৪৯০ টাকা মূল্যমানের পাঞ্জাবি সবচেয়ে বেশি চলছে।

এই বিপণিবিতানে আড়ংয়ের অন্য পোশাকের তুলনায় পাঞ্জাবি সেকশনে সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেল। সাদা, অফ হোয়াইট প্রিন্ট এবং হালকা কাজের পাঞ্জাবির চাহিদা বেশি।

এখানে কেনাকাটা করতে আসা আজিমপুরের ফারুক আহমেদ বলছিলেন, “একসাথে অনেক কালেকশন আছে এখানে। যেহেতু পরিবারের জন্য ৬-৭টি পাঞ্জাবি কিনতে হচ্ছে, সেজন্য একটু দেখে কিনছি।”

নিউ মার্কেট এলাকার বিপণিবিতানগুলোতেও পাঞ্জাবির দোকানে বেচাকেনা চলছে বেশ। সেখানে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকার পাঞ্জাবিই বেশি বিক্রি হচ্ছিল।

নিউ সুপার মার্কেটের নিহা ফ্যাশনের বিক্রয়কর্মী বাবু জানান, প্রিন্টের পাঞ্জাবি বেশি বিক্রি হচ্ছে। হাতে ও গলায় এমব্রয়ডারির কাজ করা পাঞ্জাবি খুঁজছেন ক্রেতারা। মেরুন, নেভি ব্লু, জলপাই, আকাশী, পেস্ট, বেগুনি ও থ্রিডি প্রিন্টের পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে ভালো।

এলিফ্যান্ট রোডের নূর ম্যানশন শপিং সেন্টারের মনিকা ফ্যাশন পাঞ্জাবির বিক্রয়কর্মী সজীব জানালেন, এই দোকানে ৩০০ টাকা থেকে পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিক্রি বেশি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার পাঞ্জাবি। তরুণরা রঙদার ও কাজ করা পাঞ্জাবিতে বেশি ঝুঁকছে।

সুতি কাপড়ে ব্লক প্রিন্টের পাঞ্জাবির পাশাপাশি হাফ সিল্ক, কাতানের উপর কারচুপির কাজ করা পাঞ্জাবিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন ক্রেতারা।

এছাড়া ডিজিটাল প্রিন্ট, সুলতান কটন, অরবিন্দ, সিল্ক এবং তসরের কাপড়ের পাঞ্জাবিরও চাহিদা রয়েছে।

নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তবিবুর রহমান জানালেন, নিজের জন্য ও বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনেছেন তিনি।

তার কথায়, “ঈদে অন্য কিছু কিনি আর না কিনি, পাঞ্জাবিটা লাগে। ভালো লাগলে শার্ট কিনব, কিন্তু এত জরুরি না।”

আর মিরপুরের ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয়া মার্কেটে দেখা গেল, পোশাকের মধ্যে সবচেয়ে কম ভিড় শাড়ির ব্লকে। জাকাতের জন্য কম দামের সুতি শাড়িই বিক্রি হচ্ছে বেশি।

এই মার্কেটের সুজন বেনারশী হাউজের কর্ণধার রফিকুল ইসলাম বলেন, “জাকাত দেওয়ার জন্য অনেকে বেশি করে শাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুরুব্বিদের জন্য উপহারের শাড়ি কিনছে। অন্য বেচাবিক্রি তেমন নাই।”

সেই তুলনায় ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে শাড়ির বিক্রি ভালো দেখা গেছে। এই মার্কেটেও সুতি শাড়ির চাহিদা বেশি।

বস্ত্র বিতানের ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম জানালেন, জাকাতের শাড়ির বিক্রি অনেক বেশি হয়েছে। এই শাড়ির দাম ২৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হলেও চাহিদা কমেনি।

এর বাইরে পরিবারের বয়স্ক নারীদের উপহারের জন্যও শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। তবে কাতান শাড়ির বিক্রি কম।

এই মার্কেটের স্বপ্নের কুটির শাড়ি হাউজের বিক্রয়কর্মী তারেক হাসানের ভাষ্য, ২০১৯ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ শাড়িও বিক্রি হয়নি।

“আমাদের এখানে ১৫-২০ রোজায় ভাল বিক্রি হয়। এবারে বেচাবিক্রি তেমন নাই, জাকাতের শাড়ির কিছু সেল হইছে। সংঘর্ষের কারণে গুলশান-বনানীর যারা একসাথে অনেক শাড়ি কেনে, তারা এ এলাকায় আসেনি।”

ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে আত্মীয়স্বজনদের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছেন ইয়াসির আহমেদ।

কথায় কথায় বলছিলেন, “গ্রামে অনেকে আছে, যারা আশা করে থাকে। তাদের জন্য এখান থেকেই সবসময় শাড়ি কিনি। এবারও কিনলাম। এখানে অনেক শাড়ি কিনলে দামটা একটু কম পাওয়া যায়।”

মিরপুর বেনারশী পল্লীতে শাড়ির বিক্রি মূলত বিয়ের মৌসুম কেন্দ্রিক। তবে ঈদেও কিছুটা জমে ওঠে শাড়ির এই বৃহৎ বাজার। এবার অনেকটা ফাঁকা দেখা গেল এখানকার দোকানগুলো।

এই মার্কেটের মিতু কাতান শাড়িতে স্বজনদের জন্য শাড়ি কিনছিলেন নুসরাত ইসলাম। তিনি জানালেন, নিজের জন্য থ্রি-পিস কিনেছেন তিনি।

“প্রোগ্রাম ছাড়া তো শাড়ি পরা হয় না, তাই শুধু শুধু কিনে কী করব? মায়ের জন্য, শাশুড়ি ও ভাইয়ের বউয়ের জন্য কিনলাম।”

ডায়মন্ড বেনারশীর ম্যানেজার নাজিব হোসেন জানালেন, রোজায় তাদের এমনও দিন গেছে যে একটি শাড়িও বিক্রি হয়নি।

“ঈদে এমনিতে কম বিক্রি হয়। কিন্তু এবার অন্য বছরের চেয়েও সেল কম যাচ্ছে। রোজায় এমনও গেছে যে ৩-৪ দিন কোনো বিক্রি করতে পারিনি সারাদিনে। গতবছর ১৫-১৬ দিন খোলা থাকলেও এর চেয়ে বেশি কাস্টমার পাইছি।”

একই চিত্র দেখা গেছে মায়াভরী শাড়ির দোকানেও। এই দোকানের বিক্রয়কর্মী রবিন হাসান জানান, হাতেগোনা কিছু কাস্টমার আসছে, যারা মূলত গিফটের জন্য শাড়ি কিনেছে।

বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে প্রাইডের ব্যবস্থাপক শামসুন্নাহার ডলি জানালেন, স্বাভাবিক সময়ের ঈদে শুক্র-শনিবার তাদের ৪-৫ লাখ টাকার শাড়ি বিক্রি হত, এবার তা নেমে এসেছে এক লাখে।

বেইলি রোডের টাঙাইল শাড়ি কুটিরে গত দুই বছরের তুলনায় ভালো বিক্রি হলেও মহামারীর আগের তুলনায় বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে।

এর স্বত্বাধিকারী মুনিরা ইমদাদ জানান, গরমের কারণে সুতি শাড়ি বেশি বিক্রি হয়েছে। এছাড়া হাফ সিল্ক, মসলিন শাড়িও ভাল বিক্রি হয়েছে।

“ভেবেছিলাম এবার ঈদটা অন্যরকম হবে, মানুষ অনেক কিনবে; যেহেতু দুই বছর তারা কিছু কিনতে পারেনি। কিন্তু এমন তো হল না। মানুষের চাহিদা নাই, নাকি হাতে টাকা নাই- তা বুঝতে পারছি না।”