পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধার পাথর শ্রমিক মকছেদ আলী বলছিলেন তার উপলব্ধির কথা; যিনি জীবনভর মহানন্দা নদী থেকে পাথর উত্তোলন করে সংসারের জোয়াল টানছেন। নদীই তার কাছে ‘সব’।
দেশের সীমান্ত এলাকা বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার অংশে বাংলাদেশ ও ভারতকে দুভাগ করে বইছে মহানন্দা। এই নদী থেকে পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন এলাকার হাজার হাজার শ্রমিক।
মহানন্দা ছাড়া আছে করতোয়া, ডাহুক নদী; সেখান থেকেও পাথর তোলেন শ্রমিকেরা।
মকছেদ আলীর মতোই পাথর শ্রমিক শাহজালাল, শামসুল, বিলকিস, শুভ বলেছেন, নদীতে নানা বিপদ-আপদ থাকলেও নদীই তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
মানুষ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নদীর গভীর অংশ থেকে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করেন
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীতে পাথর কমেছে, আকৃতি ছোট হচ্ছে পাথরের, কিন্তু জীবিকার তাগিদে প্রকৃতির সব প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে পাথর তোলার কাজটি করে যাচ্ছেন এসব শ্রমিক। সরকারি আর্থিক সুবিধা বঞ্চিত এই শ্রমিকদের কেউ কেউ ৩০ বছর ধরেও পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারও কারও পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই পাথর তোলার কাজে নিয়োজিত।
কষ্টসাধ্য কাজটি করতে একটু বয়স হলেই কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু টাকার অভাবে চিকিৎসা নেই তাদের। কেউ কেউ আবার ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর চোখ রাঙানির অভিযোগও করেছেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নদীর গভীর থেকে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করেন। সেই পাথর বিক্রি করেন মহাজনদের কাছে। আর মহাজনরা তা ট্রলিতে ভরে নিজের আস্তানায় নিয়ে যান ও ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করেন।
সরজমিনে দেখা গেছে, ভোর হতেই পাথর শ্রমিকরা টায়ারের টিউব, কোদাল, শিক, ও চট বা প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে দলে দলে নদীতে আসেন।
পাথর শ্রমিক শুভ (২৫) নদীতে টায়ারের টিউবটি নিয়ে নামেন। সেই টিউবের মাঝখানে রশি দিয়ে বেঁধে চট বা প্লাস্টিকের ছালা বিছিয়ে তাতে পাথর রাখেন। ভেতরে বাতাস থাকায় টিউব নদীর পানিতে ভাসতে থাকে। পাথরের পরিমাণ বাড়তে থাকলে সেগুলো তীরের শুকনা জায়গায় রাখেন, এভাবে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
শ্রমিকদের প্রায় প্রত্যেকের কাছে টিউবসহ পাথর তোলার কোদাল, শিক থাকে। এসব যন্ত্রপাতি তাদের নিজেদের বা মহাজনের কাছ থেকে আনা। পাথর বিক্রি করে অনেকে আবার মহাজনকে যন্ত্রপাতির টাকা শোধ করে দেন।
বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া সদর পর্যন্ত গ্রামের প্রায় সব পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য পাথর সংগ্রহের কাজে জড়িত বলে জানান বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুদরত ই খুদা মিলন।
জীবিকার তাগিদে প্রকৃতির সব প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে পাথর তোলার কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন শ্রমিকেরা
সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এ পেশায় জড়িত উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, মহানন্দার তীর সংলগ্ন প্রতিটি এলাকার, প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ পাথর তোলার কাজে সম্পৃক্ত আছে। এটা তাদের পারিবারিক পেশা বা ঐতিহ্যে দাঁড়িয়ে গেছে।
তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধার জমাদারগছ গ্রামে চল্লিশোর্ধ্ব মকছেদ আলীর ছয় ভাইয়ের মধ্যে পাঁচজনই এই পেশায় এসেছেন। প্রতিদিন খুব ভোরে পাথর তুলতে নেমে পড়ে এই পরিবার। ভাইয়েরা একজনকে দেখেই অন্যজন পাথর তুলতে শিখেছেন।
মকছেদ আলীর ভাষায়, “দুনিয়াতে এরকম কষ্টের কাজ আর নেই।“
তাই তিনি তার তিন ছেলের কাউকেই পাথর তোলার কাজে আনেননি। ছেলের একজন পড়ছে উচ্চমাধ্যমিকে, আরেকজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, কাজে আনেননি বাড়ির বউদেরও। প্রায় ২০ বছর ধরে অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য এই কাজটি করে এখন প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগছেন মকছেদ আলী।
“শ্বাসকষ্টে আমার জীবন প্রায় যায় যায় অবস্থা। ওষুধ খেয়ে টিকে আছি। ভালো করে চিকিৎসক যে দেখাব তারও উপায় নেই। একে সংসার চালাতে হয় তার ওপর ছেলেদের লেখাপড়া, সাংসার ও চিকিৎসার খরচ। সামলানো যায় না।”
৪৫ বছরের জীবনে ত্রিশ বছর ধরে পাথর তোলার কাজ করা শাহজালাল পাশাপাশি গোয়ালগছ বিওপি জামে মসজিদে খতিবের কাজও করেন।
জমাদারগছ গ্রামের এই বাসিন্দা বলেন, “নদীর ইনকাম দিয়েই চলি। কষ্ট হলেও চলে যায়।”
শাহজালালের বড় ভাই ও তাদের ছেলেরাও পাথর তোলার কাজ করে। তবে বয়স বাড়ায় আগের মতো টানা কাজ করতে পারেন না, কিছুক্ষণ কাজ করে বিশ্রাম নেন, তারপর আবার নদীতে নামেন।
প্রমিকদের প্রায় প্রত্যেকের কাছে টিউবসহ পাথর তোলার কোদাল, শিক থাকে
নদীটি সীমান্ত এলাকায় পড়ায় প্রায়ই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ পাথর তোলায় বাধা দেয় বলে অভিযোগ করেন শাহজালালের বড় ভাই শামসুল (৫৫)।
“কখনও বন্দুক তাক করে ধরে গুলি করার হুমকি দেখায়। পরিস্থিতি খারাপ হলে পাথর তুলতে পারি না।”
নদী থেকে পাথর তোলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে এই শ্রমিক বলেন, প্রথমে লোহার শিক দিয়ে পানির নিচে খুঁচিয়ে দেখা হয় পাথর আছে কি না। থাকলে কোদাল দিয়ে পাথর তোলা হয়। খোঁজাখুঁজি এবং তুলতে বেলা গড়িয়ে যায় শ্রমিকদের।
নদীতে এখন বেশি পাথর পাওয়া যায় না বলেও জানান শামসুল। তিনি বলেন, “১০ খানে খুঁজলে এক-দুই জায়গায় পাথর পাওয়া যায়। এজন্য পাথর পেতে অনেক সময় লেগে যায়।”
শামসুল আরও বলেন, প্রতি ট্রলিতে ১০০ সিএফটি (ঘনফুট) বা তার বেশি পাথর তোলা যায়। তিনি দুই সপ্তাহে কমবেশি এক ট্রলি পাথরে তুলতে পারেন।
এ কাজে এগিয়ে অল্প বয়সী শ্রমিকরা, তারা অনেক কম সময়ে এক ট্রলি পাথর তুলতে পারেন জানিয়ে শামসুল বলেন, “তারা ১৫ টাকা থেকে সাইজ অনুযায়ী ৪০ টাকা পর্যন্ত প্রতি ঘনফুট পাথর বিক্রি করেন।”
জীবনভর এই কাজ করেই সংসার চালিয়ে মেয়েকে ডিগ্রি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন বলে জানান শামসুল। রোদে-জলে-বৃষ্টিতে বা তীব্র শীতেও ভোর থেকে শুরু করে দিনমান চলে পাথর তোলার কাজ। দিনশেষে সামান্য যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই সংসার চালানো শাসমুলের ভাষ্য, “নদীতে নানা বিপদ-আপদ হলেও এই নদীই আমাদের মতো অনেককে বাঁচিয়ে রেখেছে।“
যত দিন যাচ্ছে মহানন্দায় পাথর কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। আবার যে পাথর মিলছে সেটি আকারেও ছোট তাই দামও কম।
শ্রমিক আমজাদ হোসেন (৫৫) ২০ বছর ধরে ১০ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম থেকে মহানন্দায় এসে সকাল-সন্ধ্যা পাথর তুলছেন। কষ্ট করে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন পাঁচজনের সংসার।
প্রথমে লোহার শিক দিয়ে পানির নিচে খুঁচিয়ে দেখা হয় পাথর আছে কি না, থাকলে কোদাল তিয়ে পাথর তোলা হয়।
এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, কলেজে পড়াচ্ছেনও আরেক মেয়েকে। সামন্য আয়ে কিছু সঞ্চয়ও করেছেন এই শ্রমিক।
কিন্তু এতোদিন ধরে পাথর তোলার কাজ করে এখন কোমরের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন আমজাদ। তবে খরচের ভয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হননি তিনি।
শ্রমিক সাহাজুল ইসলাম বলেন, পাথর উত্তোলন ও আয় নির্ভর করে আবহাওয়া কিংবা সূর্যের আলোর ওপর। বিশেষ করে শীতের সময় এমন নির্ভরতা বেশি থাকে।
“সূর্য ওঠার পর পরই নদীতে যেতে হয়, আসতে হয় সূর্য ডোবার কিছু আগেই। শীতের সময় খুব অল্প সময় নদীতে থাকতে পারি। নদীর পানি এমন ঠাণ্ডা থাকে যে নদীতে বেশিক্ষণ থাকা যায় না।”
“এমন শীত যে মানুষকে খুন করলেও মানুষ টের পাবে না”, ভাষ্য এই শ্রমিকের।
শ্রমিক শুভ জানালেন, কোভিড মাহামারীর কারণে এলাকার অনেকেরই তেমন কোনো কাজ নেই। ঢাকায় কাজ হারিয়ে অনেকেই এখানে নদীতে এসে জীবিকা খুঁজে পেয়েছেন। দিনে ৫০০ টাকা মজুরিতে পাথর তোলার কাজ পেয়েছেন, তাতেই চলছে সংসার।
শ্রমিক বিলকিস বেগম ‘পাথর ভাঙা মেশিনে’ পাথর তুলে দিতে কাজ করেন। ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে এ কাজ করেন তিনি। নিজের এবং স্বামীর আয় মিলিয়ে বেশ ভালোভাবেই সংসার চালিয়ে নেওয়া এই শ্রমিক বলেন, এই এলাকায় অনেক নারীই তার মতো পাথর তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন।
“কোনো সময় বাড়ির ছোটরাও পাথর বাছার কাজে সহযোগিতা করে। এতে তাদের খেলার সময়টাও কাটে আমাদেরও সহায়তা হয়।”
শ্রমিকরা টায়ারের টিউব, কোদাল, শিক ও চট বা প্লাস্টিকের ছালা-বস্তা নিয়ে দলে দলে নদীতে আসেন।
মহামারীর দুই বছরে স্কুল বন্ধ থাকায় তার ছেলে (১২) তাদের সঙ্গে পাথর তোলার কাজ করেছে জানিয়ে বিলকিস বলেন, এখন স্কুল খোলায় ছেলেকে ঈদের পর স্কুলে পাঠাবেন।
সিপাহীপাড়ার পাথর শ্রমিক আবু হাসান (৪০) অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের কোনো সহযোগিতা করে না সরকার। করোনাভাইরাসের সময় সরকার এত কিছু দিয়েছে, কিন্তু আমাদের কপালে জোটেনি।”
এই কাজে সরকারের নজর না থাকার আক্ষেপ করেছেন বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুদরত ই খুদা মিলন।
তিনি বলেন, “আমার এলাকার অধিকাংশ পরিবার চলে নদীর আয়ে। তাদের সংসারে ঝামেলাও শোনা যায় না। দরিদ্র এলাকা হলেও ত্রাণের চাহিদা নেই বললেও চলে। পাথরই তাদের এমন সাহস জুগিয়েছে। তাদের এমন সাহস আামকেও সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগায়।”
পাথর ব্যবসায়ী জাহিরুল ইসলামের বক্তব্যেও প্রকৃতির সঙ্গে পাথর শ্রমিকদের যুদ্ধ করে টিকে থাকার কথা উঠে আসে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রমিকরা কনকনে শীতে, বৃষ্টিতে কিংবা গরমে পাথর উত্তোলন করে সংসার চালায়৷ তারপরও সারাদিন পাথর উত্তোলন করে যা পায় তা দিয়ে তারা সংসার চালান। আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের কাছে পাথর ক্রয় করার বিক্রি করে যে লাভ হয় তা দিয়েই চলি।”
“আমরা ব্যবসায়ীরা যতটুকু পারি চেষ্টা করি শ্রমিকদের সহযোগিতা করার। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নয়। তাই সরকার সহযোগিতা করলে শ্রমিকরা উপকৃত হতেন।”
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা জানান, সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় তেমন কোনো শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় কর্মসংস্থানের অভাব থাকলেও এখানকার অনেক মানুষ মহানন্দা, করতোয়া ও ডাহুক নদীতে পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
“আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব শ্রমিকদের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। এসব সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।“