ক্যাটাগরি

কুরোসাওয়ার চোখে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী

১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় রায় পরিবারে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়; বাবা ছিলেন সুকুমার রায়, ঠাকুরদা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়। 

সাহিত্যিক, আঁকিয়ে, সঙ্গীতস্রষ্টা, চলচ্চিত্রকার নানা পরিচয়ে সত্যজিৎ হয়ে ওঠেন এসব জগতের মহীরুহ।

তার জন্মবার্ষিকীতে ভারতীয় সংবাদপত্র এবিপির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সত্যজিতের প্রথম সিনেমাকে কীভাবে মেপেছিলেন দুবার অস্কারজয়ী জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা কুরোসাওয়া।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়ন ঘটিয়ে ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঝুলিতে পুরোছিলেন সত্যজিৎ।

কুরোসাওয়া বলেছিলেন, সত্যজিতের সিনেমাটোগ্রাফিক প্রযুক্তিতে অপ্রাসঙ্গিক বা এলোমেলো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না, এটাই তার শ্রেষ্ঠত্বের রহস্য।

আকিরা কুরোসাওয়া

আকিরা কুরোসাওয়া

পথের পাঁচালীর গল্পের প্লট, বর্ণনা ও নিমার্ণ শৈলীতে বিশ্বজুড়ে অভাবনীয় প্রসংসা কুড়ালেও সম্ভবত এই সিনেমাটির প্রশংসা ও আলোচনায় সবচেয়ে উদার ভূমিকায় দেখা গেছে কুরোসাওয়াকে।

“শান্ত কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণ এবং মানুষের জন্য ভালোবাসা, মানবিকতার পরশ মেলে সমস্ত সিনেমাটিতে, যা আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে,” বলেছিলেন কুরোসাওয়া।

জাপানি এই নির্মাতা মনে করেন, চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ এক অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব।

১৯৭৫ সালে মস্কোতে তিনি বলেছিলেন, সত্যজিতের সিনেমা না দেখা হল ‘সূর্য বা চাঁদ না দেখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা’।

পথের পাঁচালী দেখার পর মনের ভেতরে যে আলোড়ন উঠেছিল সেটি ভোলার নয় বলে মন্তব্য করেন কুরোসাওয়া।

১৯৮৭ সালে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকীতে তিনি বলেছিলেন, “পথের পাঁচালী এমন এক ধরনের সিনেমা, যেখানে নদীর নির্মলতা যেমন মিশে আছে, তেমনি প্রকাশ পেয়েছে নির্মাতার কাজের আভিজাত্য।”

সত্যজিৎ তার সিনেমায় গল্পের ছবি এঁকে দর্শকের মনে গভীর আবেগ জাগিয়ে তুলতে পারেন মন্তব্য করে তা কীভাবে তিনি করেন, তা নিয়ে বিস্ময়ও প্রকাশ করেন তিনি।

এক জীবনে সত্যজিৎ

প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও সুপ্রভা রায়ের সন্তান সত্যজিৎ রায়ের ডাক নাম ছিল মানিক। তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মসুয়া গ্রামে পৈতৃক নিবাস হলেও ১৯২১ সালের ২ মে উত্তর কলকাতায় জন্ম নেন সত্যজিৎ। শিশুকালের লেখাপড়া বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে, পরে অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর লেখাপড়া করতে যান শান্তিনিকেতনে।

বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ৮০ টাকা বেতনে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৪৩ সালে কাজ শুরু সত্যজিতের। এরপরই বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনায় গ্রাফিক শিল্পী হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। এই পেশাতে থাকার সময়েই ‘পথের পাঁচালী’র ছোটদের সংস্করণ এবং ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়েই সিদ্ধান্ত নেন ‘পথের পাঁচালী’কে সেলুলয়েডে আনবেন।

প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্যঁ রেনোয়া কলকাতায় তার ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে সহকারী হিসেবে পেয়েছিলেন সত্যজিৎকে। ওই কাজটি করতে গিয়েই নিজেকে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করেন সত্যজিৎ।

১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী, প্রথমেই বাজিমাৎ। এই সিনেমাটি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি।

এই ট্রিলজির পরের দুটি সিনেমা ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’। ‘অপরাজিত’র সাফল্য তাকে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে।

সত্যজিৎ তার দীর্ঘ নির্মাতা জীবনে একের পর সিনেমা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘তিন কন্যা’, ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘চারুলতা’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘অরণের দিনরাত্রি’, ‘নায়ক’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’,‘হীরক রাজার দেশে’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘গণশক্র’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’সহ আরও সিনেমা।

১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তার বাবা সুকুমার রায়ের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।

সত্যজিৎ রায় তার জীবদ্দশায় বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছিল। পেয়েছেন ফ্রান্স সরকারের বিশেষ সম্মাননা, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৯৯২ আসলে অস্কার কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে। ভারত সরকারও দেয় ভারতরত্ন খেতাব। মৃত্যুর পর মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কারও দেওয়া হয় তাকে।

সিনেমা নির্মাণের বাইরে গোয়েন্দা ফেলুদার স্রষ্টা হিসেবেও বাঙালি পাটক মনে রাকবে সত্যজিৎকে।

১৯৮৩ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন সত্যজিৎ, এরপর তার কাজের গতি ধীর হয়ে আসে। গুণী এই নির্মাতার জাগতিক ভ্রমণ শেষ হয় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল।