ক্যাটাগরি

বিএটিবিসির শত কোটি টাকা: শেষ পর্যন্ত ইউনিয়ন ক্যাপিটালকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক

আর্থিক সংকটের কারণে চার বছরের বেশি সময় পরও বহুজাতিক সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানিটির কর্মী মুনাফা তহবিলের এফডিআরের (মেয়াদি আমানত) এ টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড।

এ নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত উভয় কোম্পানির মধ্যে ২০১৮ সাল থেকে দেন দরবার চললেও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

রোববার এমন প্রেক্ষাপটে উভয় কোম্পানিকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সূচি রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। বৈঠক ডাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ইস্যুতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে। আগামী রোববার অনুষ্ঠেয় ইউনিয়ন ক্যাপিটালের সঙ্গে বৈঠকটিও সেরকমই।

“এফডিআর ইস্যু নিয়ে তারা (বিএটিবিসি) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সমাধান চেয়ে আবেদন জানিয়েছে।”

বৈঠকে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ এন এম গোলাম শাব্বির, বিএটিবিসির প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের থাকার কথা রয়েছে।

২০১৭ সালে এক বছরের মেয়াদে ১০ শতাংশ সুদে রাখা ১০০ কোটি টাকার এফডিআর এখন সুদ সমেত ১১০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি বিএটিবিসির।

মেয়াদি এ আমানতের প্রথম মেয়াদ পূর্তির বছর ২০১৮ সালের শুরু থেকেই টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খেতে থাকে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। ওই বছরই আসল ও সুদের অর্থ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করে কোম্পানিটি শুধু সুদের কিছু অর্থ ফেরত দেয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত খুব বেশি টাকা ফেরত পায়নি বিএটিবিসি। সময়ে সময়ে সুদের কিছু অর্থ ফেরত দিলেও আমানতের পুরোটাই অপরিশোধিত রয়ে গেছে। মোট কত টাকা পাওয়া গেছে- সে তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি বিএটিবিসির কোম্পানি সচিব মো. আজিজুর রহমান।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এখন টাকা ফেরত দিতে না পেরে ১ শতাংশ সুদে ২০২৯ পর্যন্ত এফডিআর নবায়ন করে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। ২০৩০ সালে সমুদয় অর্থ ফেরত দিবে কিস্তিুতে। এ সময়কে ‘অনেক লম্বা’ উল্লেখ করে প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিটি।

বিএটিবিসির কোম্পানি সচিব মো. আজিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অর্থের পরিমাণ তো এখন ১১০ কোটি টাকা। আমরা কিছু টার্ম ও কন্ডিশনের আওতায় এফডিআর হিসেবে রেখেছিলাম ইউনিয়ন ক্যাপিটালে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ২০১৮ সাল থেকে তারা নন-কমপ্লায়েন্সে যায়।

“এটা নিয়ে তো দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। তারা নানা ধরনের চালাকির আশ্রয় নিচ্ছে। একেক সময় একেক ধরনের কথা বলছে। এক পর্যায়ে তারা লম্বা সময় চেয়েছিল অর্থ পরিশোধে যেটা আমরা ডিসএগ্রি (মেনে নেইনি) করেছি।”

সার্বিক বিষয়ে জানতে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের কোম্পানি সচিব আব্দুল হান্নানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এ নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে তিনি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম শাব্বিরকে অবহিত করেছেন। তবে এমডি কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন।

প্রথম বছর থেকেই অর্থ পাচ্ছে না বিএটিবিসি

১০ শতাংশ সুদে ২০১৭ সালে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের কাছে এক বছরের জন্য এফডিআর হিসেবে ১০০ কোটি টাকা রাখে বিএটিবিসি। কোম্পানিটি ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপ্যান্ট ফান্ডের (ডব্লিউপিপিএফ) এ অর্থ মেয়াদি আমানত হিসেবে সেখানে রেখেছিল।

এক বছরের জন্য রাখা তহবিলটির মেয়াদ পূর্তি হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেই। মেয়াদ পূর্তির পর ২০১৮ সালে বিএটিবিসি আমানত তুলে নিতে চাইলে তা পরিশোধে ব্যর্থ হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধতন এক কর্মকর্তা।

এরপর অর্থ ফেরত পেতে ইউনিয়ন ক্যাপিটালকে অন্তত ২০ বার চিঠি দেয় বিএটিবিসি, বৈঠকও করে একাধিকবার। তবে গত চার বছরে কোনো সুরাহা হয়নি।

বিএটিবিসি বলছে, এফডিআরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অর্থ ফেরত দিতে না পারার কারণ হিসেবে ২০২১ সালে কোভিড মহামারীতে তারল্য সংকটের কথা ইউনিয়ন ক্যাপিটাল জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে অর্থ ফেরত দেওয়ার দিতে রাজি হয় তারা।

সেই ‘সমঝোতা’ অনুযায়ী ২০২১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ২০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার থাকলেও তা হয়নি। এ সময়ে প্রতিশ্রুত সুদহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।

এরপর অর্থ ফেরতে অনিশ্চয়তা দেখে ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে সমাধান চেয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করে বিএটিবিসি। এ চিঠির কপি বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম দেখতে পেয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠক হতে যাচ্ছে।

৩ বছর ধরে লোকসানে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল

বিএটিবিসির আমানত ফেরত দিতে না পারার পরের বছর ২০১৯ সাল থেকেই লোকসানে যায় ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।

নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে এখনও টানা লোকসানে কোম্পানিটি। ওই বছর লোকসান হয় ১০৬ কোটি টাকা, পরের বছর ৫৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং ২০২১ সালে লোকসান দিয়েছে ১৪৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

সবশেষ হিসাব বছর ২০২১ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা। লোকসানি হওয়ায় ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। কোম্পানিটির অন্যান্য আর্থিক সূচকও ভালো না।

এছাড়া ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মসহ নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাওয়া ডজন খানেক ব্যাংক বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘রেড জোন’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। ইউনিয়ন ক্যাপিটালও রয়েছে ওই তালিকায়।