এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ৩৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি। আর মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার।
অর্থাৎ, রাস্তায় থাকা লাইসেন্সধারী মোটরসাইকেলের এক তৃতীয়াংশ চালাচ্ছেন এমন চালকরা, যাদের ড্রাইভার্স লাইসেন্স নেই।
মঙ্গলবার ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনা আহত হয়ে যারা চিকিৎসা নিতে এসেছেন, তাদের একটি বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত এরকম ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের সাতজনেরই লাইসেন্স ছিল না।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মোগরাপাড়া এলাকার ২৪ বছরের তরুণ নাজিম উদ্দিন ঈদের দিন বেড়াতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স তার নেই। নিজের মোটরসাইকেলও নেই। বন্ধুর মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে ওই দুর্ঘটনায় পড়েন।
নাজিম উদ্দিন বলেন, “সব সময় না, মাঝেমধ্যে বাইক চালাই। নিজের বাইক নাই, এজন্য লাইসেন্সও করা হয় না।”
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার রাচ্চু শেখ পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গত ৩০ মার্চ। বন্ধুর মোটরসাইকেলে চড়ে দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি। ওই দুর্ঘটনায় আহত তার সেই বন্ধুরও মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স ছিল না।
“গোপালগঞ্জ শহরেই ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোটরসাইকেলের। আমার পায়ের শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা ঠিক না হলে হাড়ের অস্ত্রোপচার করা যাবে না। এজন্য এতদিন ধরে অপেক্ষায় আছি। যে বন্ধুর বাইকে চড়েছিলাম তার কোনো লাইসেন্স নাই, আমারও নাই।”
নরসিংদীর মাধবদী এলাকার তরুণ রিপন মিয়াও ঈদের দিন বেড়াতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভেঙেছেন। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রিপন জানালেন, দুই মাস আগে মোটরসাইকেল কিনেছেন, তবে চালানোর লাইসেন্স করেননি।
“নতুন হুন্ডা মাত্র কিনছি। আসলে লাইসেন্স করমু, করমু চিন্তা কইরা করি নাই। এর আগেই তো অ্যাকসিডেন্ট করলাম।”
তবে দুর্ঘটনায় আহত মানিকগঞ্জের সিয়াম মোল্লা, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার সবুজ খান, শরীয়তপুর সদর উপজেলার সাইফুল ইসলামের লাইসেন্স ছিল।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রতিদিন গড়ে ২০০ জন রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন।
“এ বছর তা বেড়েছে, ঈদের সময় দুর্ঘটনার প্রবণতা আরও বেশি হয়েছে। যত রোগী আসছেন, তার মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আসছেন।”
হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি ঘটে ঢাকার বাইরে। ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের বেশিরভাগেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই।
“আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ঢাকায় দুর্ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম। কারণ এখানে অতিরিক্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর সুযোগ কম। আর ঢাকায় লাইসেন্স ছাড়া বাইক চালানোও কঠিন।
“ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসে, তাদের মধ্যে লাইসেন্সধারী খুব কম। তারা হয়ত মনে করে যে টাকা দিয়ে বাইক কিনলেই হল। লাইসেন্সের দরকার নাই, পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নাই, নিয়মনীতি জানা ও মানারও দরকার নাই।”
বাংলাদেশ রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারাদেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জনের মৃত্যু হয়; ওই বছর আহত হন ৭ হাজার ৪৬৮ জন।
এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২ হাজার ২১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাতে মোট দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।
ফাইল ছবি
২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। এ বছরের প্রথম চার মাসে সারাদেশে ১ হাজার ৭৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৪৪ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
এই চার মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৭২৩টি, যা মোট দুর্ঘটনার শতকরা ৪১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৮৩০ জনের, যা মোট মৃত্যুর ৩৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।
ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হলে ৯ মে বিআরটিএ এর পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞাপ্তি দেওয়া হয়।
মোটরসাইকেলকে ‘গঠনগতভাবে অপেক্ষাকৃত একটি অনিরাপদ বাহন’ হিসেবে বর্ণনা করে সেখানে বলা হয়, সাধারণত ‘যুবক বা উঠতি বয়সীরা’ এ বাহন বেশি ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর ‘প্রবণতা খুব বেশি’।
“বহুসংখ্যক অদক্ষ মোটরসাইকেল চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত মোটরসাইকেল চালনা করছে। জরুরি প্রয়োজনে স্বল্প দূরত্বে গমনের জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহারের উদ্দেশ্য থাকলেও বর্তমানে এসব যান মহাসড়ক ও দূরপাল্পায় চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। মোটরসাইকেল চালনাকালে অনেক ক্ষেত্রে হেলমেটসহ নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হচ্ছে না, ফলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত গতি, ওভারটেকিং, নিয়ম না জানা বা না মানা ইত্যাদিও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।”
বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেইফটি) মাহবুব-এ রব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। লাইসেন্স থাকা মানে ওই ব্যক্তি যে গাড়ি চালাতে পারে তার প্রমাণ।
“কারণ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই একজনকে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দেওয়া হয়। লাইসেন্স নেওয়ার আগে যানবাহন চালানোর নিয়মকানুন, ট্রাফিক আইনগুলো শিখে পরীক্ষা দিতে হয়। যারা লাইসেন্স নেন, তারা সেগুলো শিখে আসার কথা।”
ফাইল ছবি
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল চালকদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে।
“বয়স কম হওয়ার কারণে তারা লাইসেন্স নিতে পারে না। লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্করা ঝুঁকি নেয় বেশি। এ কারণে দুর্ঘটনাও ঘটে বেশি। অন্যদিকে বয়স্কদের মধ্যে যদি লাইসেন্স নাও থাকে, তারা কিছুটা হিসাব করে মোটরসাইকেল চালায়।”
বিআরটিএ এর হিসাবে, ২০১৯ সালে ৪ লাখ ১ হাজার ৪৫২টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছিল। তারপর দুই বছর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অনেকটা সময় লকডাউন ছিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ছিল। তারপরও ২০২০ সালে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৬টি এবং ২০২১ সালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৫২টি মোটরসাইকেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সারাদেশে নিবন্ধিত হয়েছে ৮৪ হাজার ৫৮৩টি মোটরসাইকেল। প্রথম দুই মাসের হারে মোটরসাইকেল নিবন্ধন হলে এ বছর মোটরসাইকেল নিবন্ধন পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সালে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ছিল ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৪টি। অর্থাৎ, পরের ১২ বছরে মোটরসাইকেল বেড়েছে ২৮ লাখ ২৯ হাজারের বেশি।
বিপুল সংখ্যক মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স না থাকার তথ্য তুলে ধরে বিআরটিএ তাদের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সন্তানদের মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছে অভিভাবকদের উদ্দেশে। পাশাপাশি বেশ কিছু সুপারিশও রাখা হয়েছে সেখানে।
সাধারণ সতর্কতামূলক বিষয়গুলোর পাশাপাশি চালক ও আরোহী সবাইকে মানসম্মত হেলমেট ও অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম, যেমন চেস্ট গার্ড, নি গার্ড, এলবো গার্ড, গোড়ালি ঢাকা জুতা বা কেডস, সম্পূর্ণ আঙ্গুল ঢাকা গ্লাভস এবং ফুলপ্যান্ট ও ফুল শার্ট ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।