ঈদ ঘিরে ১৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে বলেছে, এবার ঈদযাত্রায় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
বিষয়টিকে ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে বৃহস্পতিবার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ১৪ দিনে দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার।
এর মধ্যে ১২৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরসাইকেলের। আর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘটেছে এই দুই চাকার বাহনের দুর্ঘটনায়।
নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমে আসা খবরের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সেখানে বলা হয়েছে, এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা থেকে কমবেশি ৯০ লাখ মানুষ অন্য জেলায় গেছেন। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৩ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। বাড়ি ফিরতে এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় মোটরসাইকেলের ব্যবহারি ছিল বেশি।
এসব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই (৫১.৪২%) ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনার কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরও বিপদে ফেলছে বলে পর্যবেক্ষণ দিচ্ছে রোড সেইফটি ফাউন্ডেশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে।
“এটা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেলের ব্যবসা করতে গিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার জনসম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি-নিবন্ধন বন্ধের দাবি যাত্রী কল্যাণ সমিতির
ঈদের রাস্তায় বিপদ বাড়াবে ২ আর ৩ চাকার বাহন: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে এক তৃতীয়াংশ মোটরসাইকেল
“সরকারের উচিত গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে এবং রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা। অপ্রাপ্ত বয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে সেজন্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”
প্রতিবেদনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১ দশমিক ৯৫ শতাংশ, অন্য যানবাহনের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে ধাক্কা/চাপায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯ দশমিক ০৪ শতাংশ অন্যান্য কারণে ঘটেছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরের সময়ের চেয়ে এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের ঈদুল ফিতরের সময় ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
ঈদযাত্রার পথচিত্র
>> ১৪ দিনে ২৮৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণহানি; নারী ৩৮, শিশু ৫১
>> ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৯.৩২%, রাজশাহীতে ১৮%, চট্টগ্রামে ২০.৮৪%, খুলনায় ৯.১৮%, বরিশালে ৫.৩০%, সিলেটে ২.৪৭%, রংপুরে ৮.৪৮%, ময়মনসিংহে ৬.৩৬%
>> ঢাকা বিভাগে ৮৩ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১০৬ জনের মৃত্যু, সিলেটে ৭টি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম ৯ জনের মৃত্যু
>> ৪৬.৬৪% দুর্ঘটনা জাতীয় মহাসড়কে, ৩০.৭৪% আঞ্চলিক সড়কে
>> মোট দুর্ঘটনার মধ্যে ৬৭টি (২৩.৬৭%) ঘটনায় মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১১২টি (৩৯.৫৭%) ঘটনায় বাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হতাহত ঘটেছে
>> ২১.৯০% দুর্ঘটনায় পথচারীদের চাপা দিয়েছে কোনো যানবাহন, মৃতের তালিকায় ১৪.৩৬% পথচারী
>> দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস ১৮.৫৪%, মোটরসাইকেল ২৭.৬২%
>> ১২৮ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে
>>মোটরসাইকেলের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ১৬.১৯% ক্ষেত্রে, ৪১.৯৫% নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে
প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের চেয়ে ‘৩০ গুণ বেশি’ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মোটরসাইকেল দূরের যাত্রায় কোনোভাবেই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না।
ঈদযাত্রায় যেসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেনি সেগুলো অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসেনি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর কারণে দুর্ঘটনায় আহতের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না।
দুর্ঘটনার কারণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
সুপারিশ
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেওয়া, বিআরটিএ এর সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা করা, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমানো, গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটসাইকেল ব্যবহার নিরৎসাহিত করা, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সড়ক পরিবহন খাতের ‘নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার’ কারণে। এ অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করতে হবে।