ঈদের আগে ও পরে মাংস খেতে খেতে একঘেয়ে হন অনেকেই। অনেকে প্রাণীপ্রেম এবং আগেভাগেই স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকেও মাংস এড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন। ফলে সবজিমুখো হতেই হয়।
আবার সবজি মানেই পানসে তরকারি আর ভাজি- মুখ বাঁকিয়ে এমন ভাবার মানুষও কম নয়।
তবে খাবার টেবিলে সয়া ভুনা দিয়ে ভাত অথবা পোলাও চটকে নিয়ে তারপর কাঁচাকলার কাবাবে এক কামড় বসালে খাবার টেবিল থেকে পেট ভরে খেয়ে তবেই উঠবেন, তা সবজির দিব্যি করে বলা যায়।
কাঁচাকলার কাবাব
উপকরণ: ৫টি কাঁচাকলা, ২টি আলু (বড় বড়), ১ কাপ পেঁয়াজ বেরেস্তা, ধনে পাতা কুচি, ৬টি কাঁচামরিচ কুচি করে কাটা, আধা চামচ হলুদ গুঁড়া, উঁচু উঁচু করে ১ চা-চামচ ধনে গুঁড়া, উঁচু উঁচু করে ১ চা-চামচ জিরা গুঁড়া, ১ চামচ ভাজা জিরা গুঁড়া, দেড় চামচ গরম মসলা গুঁড়া, ১ চা-চামচ আদা বাটা, ১ চা-চামচ রসুন বাটা, ১ চা-চামচ লাল মরিচ গুঁড়া, কাবাব ভাজার জন্য সাদা তেল, দেড় কাপ ব্রেড ক্রাম্ব, ১টি ডিম, স্বাদ মতো লবণ, সামান্য গোল মরিচ গুঁড়া।
পদ্ধতি: কাঁচাকলার আগা ও পেছনের অংশ একটু কেটে নিতে হবে। খোসাসহ কাঁচাকলা সেদ্ধ করে নিতে হবে। আলুও সেদ্ধ করতে হবে। এরপর ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে কাঁচাকলা ও আলুর খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে।
আলু ও কাঁচাকলা মসৃণ করে চটকে নিতে হবে। ভর্তা যেন পানি পানি বা নরম না হয় একদম।
ভর্তা হাত বা বড় চামচ দিয়েও চটকে নেওয়া যায়। সুপার স্টোরে আলু স্ম্যাশ করার অ্যাপ্ল্যায়েন্স পাওয়া যায়; তা দিয়েও মসৃণ ভর্তা করা যায়।
এবার আলু-কাঁচাকলার ভর্তাতে পেঁয়াজ বেরেস্তা দিতে হবে। চটজলদি করতে হলে কাঁচা পেঁয়াজ কুচি দিয়েও করা যায়। আবার বেরেস্তা অথবা কাঁচা পেঁয়াজের বদলে খুব সামান্য তেলে পেঁয়াজ নরম করে নিয়েও ভর্তাতে মেশানো যাবে।
পেঁয়াজ দেওয়ার এই তিন ধরনের উপর পাকোড়ার স্বাদও বদলাবে। পেঁয়াজ বেরেস্তা করে দিলে এতে কাবাবের মতো সুগন্ধ ও স্বাদ আসে।
কাঁচামরিচ কুচি ও ধনেপাতা কুচি খুব অল্প গরম তেলে নরম করে নিয়ে ভর্তাতে দিতে হবে। কাঁচাও দেওয়া যায়।
কাবাব বানিয়ে ফ্রিজে দু-চার দিন রেখে খেতে চাইলে পেঁয়াজ, মরিচ ও ধনে পাতা কাঁচা না দেওয়াই ভালো; এতে বিশেষ করে কাঁচা পেঁয়াজ গন্ধ হয়ে যায়।
মাপ মতো বাটা ও গুঁড়া মসলা এবং লবণ দিতে হবে। সব হাত বা চামচ দিয়ে ভর্তার সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। স্বাদের কমবেশ হতেই পারে; তাই সব মাখিয়ে নিয়ে চেখে দেখতে হবে।
যদি কম কম মনে হয় তবে সাধারণত জিরা-ধনে ও গরম মসলার গুঁড়া সামান্য যোগ করে নিলেই ভর্তা একদম তৈরি।
এবার ভর্তা থেকে একটু একটু করে মিশ্রণ তুলে নিয়ে হাতে প্রথমে গোল করে তারপর চেপে চেপে কাবাব বা টিকিয়ার মতো আকার দিতে হবে। একটি থালায় সবগুলো কাবাব সাজিয়ে রাখুন।
একটি বাটিতে ডিম ভেঙে তাতে লবণ ও গোল মরিচ গুঁড়া দিয়ে ফেটিয়ে নিন। পাশপাশি একটি ছড়ানো থালাতে আগে এক কাপ ব্রেড ক্রাম্ব ছড়িয়ে দিন। বাকি আধা কাপ পরে প্রয়োজন মতো নেওয়া যাবে। এতে অপচয় কম হবে।
বাজারে অরেঞ্জ ব্রেড ক্রাম্ব মেলে; ওতে কাবাবের গায়ে সুন্দর রং আসে। বাড়িতে সাধারণ টোস্ট বিস্কুট অথবা পাউরুটি কিংবা মুড়ি গুঁড়া করে নিয়েও কাবাবের গায়ে মাখানো যাবে।
কাবাবের থালা, ডিমের বাটি আর ব্রেড ক্রাম্বের থালা পাশাপাশি রাখুন। একটি কাবাব তুলে ডিমে চুবিয়ে নিন। তারপর ব্রেড ক্রাম্বের থালায় রেখে দিন। কাবাবের উপরে ব্রেড ক্রাম্ব ছড়িয়ে হালকা চেপে দিন। ব্রেড ক্রাম্বে টিকিয়ার গোলাকার কিনারা গড়িয়ে নিন যেন টিকিয়ার চারপাশেও ব্রেড ক্রাম্ব জড়িয়ে থাকে।
কাবাব তুলে আলাদা থালায় রেখে দিন।
কাবাব ডিমে চুবানো ও ব্রেড ক্রাম্ব মাখাতে হাতের বদলে কাঁটা চামচও ব্যবহার করা যায়। অথবা একটা একটা করে পাঁচ-ছয়টা কাবাব ডিম মেখে ব্রেড ক্রাম্বের থালায় রেখে তারপর ব্রেড ক্রাম্বে গড়িয়ে নিন। এতে করে হাত বা চামচ থেকে ব্রেড ক্রাম্ব মিশে ফেটানো ডিম অযথা ঘন হবে না। আর তাতে একটা ডিম দিয়েই সবগুলো কাবাব হয়ে যাবে।
ব্রেড ক্রাম্ব গড়ানো হলে কাবাব সাজানো থালা ফ্রিজে রেখে দিন। অন্তত এক ঘণ্টা রাখলে খুব ভালো হয়; তাতে ব্রেড ক্রাম্ব কাবাবের গা থেকে ভাজার সময় খুলে তেলে ছড়িয়ে যাবে না।
এবার যখন যখন কাঁচাকলার কাবাব খেতে মন চাইবে চুলায় কড়াই চাপিয়ে তেল গরম করে নেবেন। ফ্রিজ থেকে কাবাব বার করে গরম তেলে দিয়ে ভেজে নেবেন মাঝারি আঁচে।
ভুনা ভুনা সয়া
উপকরণ: ১৫০ গ্রাম সয়াবিন (গোল আকারের), একটা ফেটানো ডিম, একটা টমেটো ব্লেন্ড করে অথবা বেটে নেওয়া, ২ টেবিল-চামচ টক দই, ২ টেবিল-চামচ পেঁয়াজ বেরেস্তা, আধা কাপ পেঁয়াজ জুলিয়ান বা ঝিরিঝিরি করে কাটা, ২ টেবিল-চামচ পেঁয়াজ বাটা, ১ টেবিল-চামচ রসুন বাটা, ১ টেবিল-চামচ আদা বাটা, ১টি শুকনা মরিচ, ৪টি কাঁচা মরিচ হাত দিয়ে ভেঙে নেওয়া, ১ চা-চামচ হলুদ গুঁড়া, ১ চা-চামচ মরিচ গুঁড়া, উঁচু উঁচু করে ১ চা-চামচ জিরা গুঁড়া, উঁচু উঁচু করে ১ চা-চামচ ধনে গুঁড়া, উঁচু উঁচু করে ১ চা-চামচ গরম মসলা গুঁড়া, ১০-১২টা মেথি দানা অথবা কসুরি মেথি আধা চা-চামচ, সরিষার তেল, লবণ, ২ চিমটি কালোজিরা।
পদ্ধতি: সয়া প্রথমে চুলায় লবণ দেওয়া ফুটন্ত পানিতে দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। সয়া সেদ্ধ হতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগে না।
সেদ্ধ করার কারণে সয়ার ভেতরে অনেক পানি থাকে, তাই সয়া হাত দিয়ে খুব করে চেপে চেপে নিতে হবে। প্রথমে হাতে গরম লাগবে, তাই ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে হালকা করে চেপে নিতে হবে। এরপর আরও দুয়েকবার চেপে নিতে হবে।
সয়ার ভেতরের পানি যতটা ঝরিয়ে নেওয়া যাবে, রান্নায় সয়া তত মজা হবে; নয়তো ফ্যাসফ্যাসে স্বাদ হতে পারে।
আরেকটি বাড়তি পদ্ধতিও করা যায়। সয়া চেপে চেপে পানি ঝরিয়ে নিয়ে এতে ফেটানো ডিম, একটু লবণ দিয়ে মেখে তারপর তেলে হালকা লাল করে ভেজে নিতে হবে। এভাবে ভেজে নেওয়ার কারণেও সয়ার ভেতরের পানি টেনে যায়।
মূল রান্না যে কোনো তেলে করা যায়, তবে সরিষার তেলে রান্নার স্বাদ একটু বাড়তিই।
তেল গরম হলে ফোঁড়ন হিসেবে শুকনা মরিচ দিয়ে নেড়ে তারপর কালোজিরা দিতে হবে। পেঁয়াজ দিয়ে নেড়ে নেড়ে নরম করে নিতে হবে; বেশি লালচে হবে না। এবার পেঁয়াজ, আদা ও রসুন বাটা দিয়ে নাড়তে হবে একটু। হলুদ, লাল মরিচ, জিরা, ধনে গুঁড়া দিয়ে মসলা খানিকটা কষাতে হবে।
যদি মসলা ছিটে আসে তবে সামান্য লবণ ও একটু একটু করে বারবার পানি দিতে হবে। মসলা কষানোর সময় স্বাদ মতো লবণ দিয়ে কষালে পরে ভুনা বা ঝোলে স্বাদ আসে।
কিছুটা কষানো হলে এতে টমেটো বাটা দিয়ে নাড়তে হবে। এবার চুলার জ্বাল একটু কমিয়ে নিয়ে টক দই দিতে হবে। জ্বাল একটু কমিয়ে নাড়লে টক দই দানা দানা বাঁধে না। তারপরও যদি দানা হয় তো একটু সময় নিয়ে ভুনতে হবে, তাহলে টক দই ভালো মতো মিশে যাবে।
টমেটো ও টক দই দেওয়ার কারণে ভুনা বা ঝোলের রংটা খুব সুন্দর হয়। টক দই দেওয়ার কারণে এক চামচ চিনি দিতে পারেন; এতেও দারুণ রং হয়। আমি অবশ্য যেখানে চিনি না দিলেও চলে সেখানে এড়িয়েই চলি।
মসলা ভুনা ভুনা হয়ে এলে এবার সয়া দিয়ে ভুনতে হবে। একটু একটু করে পানিও দিতে হবে। সয়া যত ভুনা করা যায়, এর স্বাদ তত বাড়তে থাকে।
সয়া ভুনা করার সময় লবণ চেখে দেখতে হবে আবার। ভুনা অনেকটাই হয়ে এসেছে মনে হলে এ সময় গরম মসলা গুঁড়া দিতে হবে। মেথি দানা দিতে হবে। কসুরি মেথি হাতের কাছে থাকলে বরং সেটিই দিন; অল্প করে দিলে দারুণ সুগন্ধ হয় রান্নায়।
আরও কিছুক্ষণ কষিয়ে নিয়ে পানি দিয়ে চুলার আঁচ বাড়িয়ে মাখো মাখো ঝোল করে নিতে হবে।
নামানোর ঠিক আগে কাঁচা মরিচ দিতে নাড়তে হবে। এরপর সরিষার তেল ও পেঁয়াজ বেরেস্তা ছড়িয়ে আবারও নেড়ে চুলার আঁচ বন্ধ করে দিতে হবে।
একেবারে শেষের দিকে কাঁচামরিচ ও সরিষার তেল মেশালে এতে তরতাজা সুবাস মিশে যায় যে, রান্নার আমেজটাই বদলে যায়।
আজকাল বাজারে অথবা অনলাইনে মাটির হাঁড়ি কিনতে মেলে সহজেই। এই রান্না মাটির হাঁড়িতে করলে শুধু রসনারই নয়, মনেরও তৃপ্তি আসবে শতভাগ।
ডালের চেয়েও বেশি আমিষ রয়েছে উদ্ভিজ্জ সয়াবিনে। এমনকি মাংসের চেয়ে নাকি এতে দুতিন গুণ বেশি আমিষ রয়েছে। উপরন্তু খারাপ কোলেস্টোরেল নেই। এখন অনলাইনে সয়ার বিভিন্ন পরিমাণের প্যাকেট কিনতে পাওয়া যায়।
মাংসের যে কোনো রেসিপি আসলে মাংসের বদলে সয়া দিয়ে রান্না করা যায়। খরচের দিক থেকেও সাশ্রয়ী এই সয়ার পদ; কিন্তু স্বাদ ও পুষ্টিতে কোনো ছাড় নেই।
বাড়িতে কাউকে দাওয়াত দিলে মাংসের কোনো পদ না করে বরং কাঁচাকলার কাবাব ও সয়া ভুনার সঙ্গে একটু পোলাও বেড়ে দিন। নিশ্চিত থাকুন মেহমান আঙ্গুল ও থালা চেটেপুটে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে।
আরও রেসিপি