ক্যাটাগরি

অর্থনৈতিক সংকটে দিশেহারা শ্রীলঙ্কার চা শ্রমিকরা

৪২ বছরের আরুলাপ্পান বলেন, ‘‘সংসার চালাতে আমাদের যে অর্থ প্রয়োজন এটা তার ধারেকাছেও না।”

তিন সন্তান আর বৃদ্ধা শাশুড়ীকে নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার আরুলাপ্পানের।

তিনি বলেন, ‘‘আগে আমরা দুইটি সবজি খেতাম। এখন আমরা মাত্র একটি খেতে পারি।”

কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। যার জের ভোগ করতে হচ্ছে দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।

পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী কারণে গত প্রায় দুই বছর ধরে পর্যটক শূন্য থাকায় দেশটির বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এদিকে, দেশের অবকাঠামগত উন্নয়নে ঋণ নিয়ে বড় বড় বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। ওইসব ঋণের সুদ হিসেবে শ্রীলঙ্কা সরকারকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার ‍অভাবে এখন দেশটি খাবার, জ্বালানি এবং ওষুধের মত অতি জরুরি পণ্য আমদানি করতে পারছে না। দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে জরুরি অর্থ সহায়তা চেয়েছে।

চরম মুল্যস্ফ্রীতির বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ করেছে।

অর্থনৈতিক সংকটে সব থেকে বেশি ভুগতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীকে। আরুলাপ্পান তামিল। তার নিজের কোনো জমি নেই, তাই চাষ করে ফসল ফলিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করার সুযোগও তার নেই। পরিবার নিয়ে চা শ্রমিকদের বস্তিতে বসবাস করেন আরুলাপ্পান।

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ২০০৯ সালে শান্তি ফেরে শ্রীলঙ্কায়। তারপর দেশটির অর্থনীতি তরতরিয়ে বেড়েছে।

ক্রমবর্ধমান পর্যটন শিল্প, সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতের উত্থান, চা, রাবার ও দারুচিনির মত বাগানজাত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে শ্রীঙ্কার অর্থনীতি রকেট গতি পেয়েছিল। ২০২০ সালেও দেশটি বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় দ্বিগুণ জিডিপি অর্জন করেছিল।

আরুলাপ্পান ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে গার্মেন্টসে কাজ নেন। বিয়ের পর তিনি চা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। নিজের সুবিধামত সময়ে কাজ করার সুযোগ থাকায় তিনি এই পেশায় আসেন। যেন কাজের পাশাপাশি সন্তানদের যত্ন নিতে পারেন। বাড়তি অর্থ রোজগার করতে তিনি সবিজ বিক্রিও করতেন।

কিন্তু কোভিড মহামারীতে শ্রীলঙ্কার মত আরুলাপ্পানের ভাগ্যের চাকাও বন্ধ হয়ে যায়। মাসের পর মাস দেশের অর্থনীতি অচল পড়ে থাকে। পর্যটন খাত থেকে আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় মাধ্যম পর্যটন খাত।

আরুলাপ্পান বলেন, ‘‘দিনের পর দিন আমরা শুধু ভাত খেয়ে থেকেছি।”

শ্রীলঙ্কা সরকারের আরো একটি সিদ্ধান্তের কারণে তাদের চা শিল্পকে ভুগতে হয়েছে। স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে গত বছর শ্রীলঙ্কা সরকার চা বাগানে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে। যদিও পরে তারা ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এই খাতে সার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।

ফলে এ বছরের প্রথম তিন মাসে চায়ের উৎপাদন ১৫ শতাংশ কমে গেছে। ২০০৯ সালের পর যা সর্বনিম্ন। শুষ্ক আবহাওয়া, সঙ্গে সারের উপর নিষেধাজ্ঞাকে এর কারণ বলে মনে করে শ্রীলঙ্কা টি বোর্ড।

এখন দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকা, জ্বালানি সংকট এবং আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফ্রীতি এই শিল্পকে ‘খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে’ বলে মনে করেন প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র রোশান রাজাদুরাই।

আটার দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে ভাত খেতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান আরুলাপ্পান। যদিও চালের দামও অনেক বেড়ে গেছে।

দুই কিলোমিটার পথ বাসে চড়ে তার ছোট দুই সন্তান স্কুলে যায়। গত কয়েক মাসে বাস ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় অভাবের মধ্যেও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন এই দম্পতি।

আরুলাপ্পানের স্বামী মাইকেল বলেন, ‘‘আমাদের বাচ্চারাও চা শ্রমিক হোক এটা আমি কখনো চাই না।”

তবে ছোট দুই সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে গেলেও বড় ছেলে অক্ষন রায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা স্থগিত করতে হয়েছে।

চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো ফল করলে ল্যাপটপ কিনে দেবেন। ২২ বছরের ছেলেকে এই প্রতিশ্রুতি করেছিলেন আরুলাপ্পান। যা মেটাতে দুই বছর ধরে একটু একটু করে অর্থ সঞ্চয় করছিলেন তিনি।

এখন ঝাড়ু তৈরির কারখানায় কাজ করতে কলম্বো গেছে অক্ষন। আরুলাপ্পান বলেন, তিনি তার ছেলেকে বলেছেন ‘তোমার অবশ্যই পরিবারকে সহায়তা করা উচিত’।

‘‘আমি জানি না আমার ছেলে এখন কোথায় থাকছে।”