সবাই ঘুমাতে যাবে, দক্ষিণ দিক থেকে এমন সময় একটা চিৎকার ক্রমশ স্পষ্টতর হয়- বদ্দারে বদ্দা, পানি আয়ের যে, বানের মতো করি। বদ্দারে বদ্দা, পানি আয়ের যে মহরমের ধুলার মতো করি!
সারাদিনের পরিশ্রমের কারণে ছেঁড়া দ্বীপের সবার মতো মা নীল গাইও ঘুমাতে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের বিপদসংকেত মায়ের মনে আজ আর কোনো দুশ্চিন্তা তৈরি করেনি। ছেঁড়া দ্বীপের চারদিক থেকে বাতাসের শো শো আওয়াজ। আর কিছুই শোনা যায় না। বাতাসের শব্দে ছেঁড়া দ্বীপের আর সবার শব্দ হারিয়ে যায়। তামাম দুনিয়া যেন বাতাসের ঝাপটায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে।
দ্বীপের সব বাতি নিভে গেছে বাতাসের প্রথম ঝাপটায়। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মা নীল গাই তার ছানাকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মায়ের শরীর।
তারপর? তারপর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ছেঁড়া দ্বীপ জুড়ে কোথাও প্রাণের খোঁজ পাওয়া গেল না। সর্বত্র পানি থৈ থৈ করছে। তাহলে নীল গাই ছানার কী হলো?
দুদিন পর। লাল হাতি আর তার স্ত্রী গেছে সাগর পারে খাবার খুঁজতে। এসময় তারা কিসের যেন কান্না শুনতে পেল। লাল হাতি আর তার স্ত্রী এদিকে খোঁজে ওদিকে খোঁজে। কোথাও পায় না। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কলাবনের ভেতর খুঁজে পেল একটি নীল গাই ছানা। লাল হাতি আর তার স্ত্রী এমন ফুটফুটে ছানা দেখে অবাক!
কাছেই পানিতে ভাসছে একটি ঘরের চালা। লাল হাতির স্ত্রী বলে, আমার মনে হয়, মা নীল গাই তার ছানাকে নিয়ে এই চালা ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। লাল হাতি বলে, হতে পারে। পানির প্রবল স্রোতে এক সময় হয়ত ওর মা কোথাও ছিটকে পড়েছে।
এখন তাহলে কী হবে? লাল হাতির স্ত্রীর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে।
লাল হাতি তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, চল তাহলে ওকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই।
দেখ, দেখ, কী সুন্দর! কী ফুটফুটে নীল গাই ছানাটি! খুশিতে পুলকিত লাল হাতির স্ত্রী বলে। স্ত্রীর খুশি দেখে লাল হাতি হাততালি দিয়ে হাসে।
লাল হাতির স্ত্রী বলে, নীল গাইরা কোথায় জানি হারিয়ে যাচ্ছে। কতদিন পর দেখলাম!
হুঁ…আমরাইবা কয়জন আছি? কয়দিন পর আমাদের নিয়েও এমন কথা বলবে। লাল হাতি বলল।
লাল হাতির স্ত্রীর মুখের হাসি মুহূর্তে হারিয়ে যায়। বলল, মানুষ গাছপালা কেটে, আগুন লাগিয়ে যেভাবে বন উজাড় করছে, তাতে মনে হয়, আমরা কেউ নিরাপদ নই।
ওরা নীল গাই ছানাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে। নীল গাই ছানা বড় হতে থাকে লাল হাতির বাড়িতে। কখনও লাল হাতির কাছে, কখনও লাল হাতির স্ত্রীর কাছে নীল গাই ছানা জানতে চায়, আমি এখানে কেন?
লাল হাতি জবাব না দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। লাল হাতির স্ত্রী নাীল গাই ছানাকে বুকে জড়িয়ে রাখে।
নীল গাই ছানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, আমি জানতে চাই আমার বেঁচে থাকার ইতিহাস।
এবার লাল হাতি আর তার স্ত্রী যা বলল তা শুনে নীল গাই ছানার ছোট্ট বুক থরথর করে কেঁপে ওঠে। দুচোখ বেয়ে পানি ঝরে।
লাল হাতি জানতে চাইল, কিরে ক্ষুধা লেগেছে?
নীল গাই ছানা বলল, মাকে মনে পড়ে।
রাতে লাল হাতি আর তার স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমাতে গেলে নীল গাই ছানা মায়ের কথা মনে করার চেষ্টা করে। পারে না। কেমন কুয়াশা কুয়াশা মনে হয়, যেন এক পাতলা কুয়াশার চাদরে মা তার মুখখানি ঢেকে রেখেছে। নীল গাই ছানার বুক ফেটে কান্না আসে। ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা তুমি কোথায়?
ওদিকে ছানা হারিয়ে মা নীল গাই পাগল প্রায়। বাবা নীল গাই ছানাকে সারা দ্বীপ খুঁজে বেড়ায়। কোথাও কোনো খোঁজ না পেয়ে একদিন নগর ভবনে গেলো। নগরপিতা সিংহকে নীল গাই বাবা সব কিছু খুলে বলল। সিংহ সব শুনে হলুদ পাখিকে নিদের্শ দিল, দ্বীপজুড়ে নীল গাই ছানার হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে দাও। হলুদ পাখি ঘুরে ঘুরে নীল গাই ছানার হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। নাচতে নাচতে বলতে থাকে, ঘোষণা! ঘোষণা! মহামূল্যবান ঘোষণা! জরুরি ঘোষণা! ছেঁড়া দ্বীপের একটি শিশু নীল গাই হারিয়ে গেছে। তাকে হারিয়ে ওর মা পাগল প্রায়। কেউ যদি নীল গাই ছানার সন্ধান পেয়ে থাকেন তবে নগরভবনে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ঘোষণা! ঘোষণা! মহামূল্যবান ঘোষণা! জরুরি ঘোষণা!
লাল হাতি ঘোষণাটি শুনতে পেল। সে তার স্ত্রীকে গিয়ে নগরপিতার নির্দেশনামা জানায়। স্ত্রী বলল, না আমি কোনো অবস্থায় আমার ছানাকে ফেরত দেব না। সে এখন আমার সন্তান। তাকে আমি লালন-পালন করছি। লাল হাতি বলল, নগরপিতার নির্দেশ না মানলে বড় বিপদ হবে যে!
স্ত্রী বলল, যত বড় বিপদ আসুক, আমি আমার ছানাকে ফেরত দেব না। নিরুপায় লাল হাতি অবশেষে হলুদ পাখির কাছে গিয়ে বলল, নীল গাই আমাদের কাছে আছে। কিন্তু মায়াবশত আমার স্ত্রী ওকে ফেরত দিতে চাচ্ছে না।
হলুদ পাখি বলল, কিন্তু এ যে নগরপিতার নির্দেশ। তার নির্দেশ না মানলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। লাল হাতি বলল, আমি জানি। কিন্তু আমি নিরুপায়। তুমি গিয়ে নগরপিতাকে এ খবর জানাও।
হলুদ পাখি যথারীতি নগর ভবনে এসে নগরপিতা সিংহকে সব জানালো। নগরপিতা খুব রাগ করল। অবশেষে ভেবেচিন্তে একটি বিচার সভা ডাকলেন তিনি। সে সভায় লাল হাতি, তার স্ত্রী, নীল গাই এবং তার স্ত্রী, হলুদ পাখি, হরিণ এবং অন্যান্য গণ্যমান্য পশু-পাখি এসে উপিস্থিত হলো।
সভায় সভাপতির আসনে বসলেন নগরপিতা সিংহ। শুরুতে হলুদ পাখি সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলল, দীর্ঘদিন খোঁজাখুঁজির পর নীল গাই ছানা লাল হাতির বাড়িতে আছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। কিন্তু…
নগরপিতা বলল, আবার কিন্তু কি? লাল হাতির স্ত্রী বলল, আমি আমার ছানাকে ফেরত দেব না।
নগরপিতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, কেন? লাল হাতির স্ত্রী বলল, আমি ওকে এতোদিন প্রতিপালন করেছি। এখন সে আমার সন্তান।
একথা শুনে মা নীল গাই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, আমি আমার একমাত্র সন্তানকে ছাড়া কী করে থাকব? লাল হাতির স্ত্রী বলল, আমিও এখন আর ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।
সবাই লাল হাতির স্ত্রীকে অনুরোধ করল শেষবারের মতো, কিন্তু সে কিছুতেই মানতে নারাজ।
লাল গাইয়ের স্ত্রী তখন দাঁড়িয়ে বলল, ধর্মাবতার, আমার একটা প্রশ্ন আছে।
লাল গাইয়ের স্ত্রীর কথায় সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল।
নগরপিতা বলল, কী প্রশ্ন?
লাল হাতির স্ত্রী বলল, ও যে নীল গাইয়ের ছানা তার প্রমাণ কী?
এমন প্রশ্নে সবাই অবাক হয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।
কেউ কেউ বলল, এতো ঠিক কথা। প্রমাণ কী?
নগরপিতা কিছু সময় নীরব থাকে। তারপর বলল, লাল হাতির স্ত্রীর প্রশ্নটি খুবই সঠিক। প্রমাণ কী? প্রমাণ চাই। আছে নাকি কোনো প্রমাণ?
বাবা নীল গাই নীরব হয়ে যায়। মা নীল গাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তখনও কাঁদছে। লাল হাতির স্ত্রী মিটিমিটি করে হাসে।
নগরপিতা বলল, প্রমাণ যেহেতু নেই, আবার সন্তান দাবি করেছে যেহেতু দু’জন, তাহলে এক কাজ করি।
তারপর নগরপিতা ছেঁড়া দ্বীপের কসাইকে ডাকল। কসাই এলে নগরপিতা নির্দেশ দিল, নীল গাই ছানাকে দুই টুকরো কর। তারপর একভাগ মা নীল গাইকে দাও। অপরভাগ লাল হাতির স্ত্রীকে দাও।
নির্দেশ শোনামাত্র মা নীল গাই চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
নগরপিতা বলল, আবার কী হলো? বিচার তো করে দিলাম।
মা নীল গাই কাঁদতে কাঁদতে বলল, ধর্মাবতার, আমার ছানার দরকার নেই। ওকে মারবেন না। আমার সন্তান লাল হাতির বাড়িতে বড় হোক। তারপরও সে বেঁচে থাক।
কিন্তু লাল হাতির স্ত্রী বলল, আমি অর্ধেকটা হলেও চাই।
নগরপিতা এবার বলল, এই যে প্রমাণ হয়ে গেল ছানার মা কে! মা কখনও সন্তানের মৃত্যু কামনা করতে পারে না। এখন আপনারা বলুন, এই ছানার মা কে? ছেঁড়া দ্বীপবাসী পশু-পাখি সবাই এক বাক্যে জবাব দিল, মা নীল গাই।
লাল হাতির স্ত্রী তখন আর কিছু বলতে পারল না। নগরপিতা নীল গাই ছানাকে তার মায়ের হাতে তুলে দিল।
কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |