তাহলে কী ঘটতে চলেছে? মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার এ ভাইরাসটি কি এখনই দুশ্চিন্তিত হওয়ার মতো? নাকি কেবলই একটি মহামারীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে সবাই বেশি উত্তেজিত?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে বিবিসি ও রয়টার্সের প্রতিবেদন ঘেঁটে।
বিবিসি লিখেছে, এটা পরিষ্কার যে মাঙ্কিপক্স আরেকটি কোভিড নয়, আর ঘটনা এমন নয় যে এর বিস্তার রোধে আরেকটি লকডাউন ঘনিয়ে আসছে।
তবে মাঙ্কিপক্সের এই প্রাদুর্ভাব অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত। বিশেষজ্ঞদেরও অবাক করেছে। আর যখন কোনো ভাইরাস আচরণ পরিবর্তন করে, তখন তা উদ্বেগের কারণ হয়েই দাঁড়ায়।
তবে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স নিয়ে অনেকটাই জানা। ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক হল বন্যপ্রাণী, আর বানরের চেয়ে ইঁদুর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার রেইন ফরেস্টের কেউ একজন সংক্রমিত প্রাণির সংস্পর্শে আসে এবং ভাইরাসটি তা থেকে ছড়িয়েছে। সংক্রমিতদের ত্বকে একটি ফুসকুঁড়ি ফুটে ওঠে, যা থেকে ফোস্কা পড়ে এবং খোসপাঁচড়া ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভাইরাসটি এখন তার স্বাভাবিক জায়গা থেকে বাইরে চলে এসেছে এবং ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এজন্য দীর্ঘস্থায়ী ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের প্রয়োজন। সেই কারণেই এর প্রাদুর্ভাব ছোট হতে থাকে এবং নিজেরাই শেষ হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অল্প সংখ্যক রোগী দেখা গিয়েছিল, সম্ভবত তারা আক্রান্ত দেশে ভ্রমণ করে নিজের বাড়িতে এ ভাইরাস নিয়ে এসেছিল।
প্রথমবারের মতো এ ভাইরাস এমন লোকদের মধ্যে পাওয়া গেছে, যাদের সঙ্গে পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার কোনো স্পষ্ট যোগাযোগ নেই। কার কাছ থেকে তারা সংক্রমিত হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়।
যৌন ক্রিয়াকলাপের সময় এটি ছড়িয়ে পড়ে এবং আক্রান্তদের বেশিরভাগের যৌনাঙ্গ এবং আশেপাশের এলাকায় ক্ষত তৈরি হয়।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্যান্ডেমিক সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক স্যার পিটার হরবি বলেছেন, “আমরা একটি খুব নতুন পরিস্থিতিতে আছি, এটি অপ্রত্যাশিত, সেই সঙ্গে উদ্বেগজনক।”
যদিও তিনি বলেছেন, এটি ‘দ্বিতীয় কোভিড’ নয়। তবে তা প্রতিরোধে ‘আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে’। কারণ এটি এমন কিছু, ‘যা আমরা সত্যিই এড়াতে চাই’।
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তদের চিকিৎসাকারী ডা. হিউ অ্যাডলারও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তার্ ভাষ্য, “এটি এমন একটি প্যাটার্ন বা ধরন,যা আমরা আগে দেখিনি। এটি অবাক করার মতো।”
মাঙ্কিপক্স ছড়িয়েছে ১২ দেশে, ছড়াতে পারে আরও
ইউরোপে ‘সবচেয়ে বড়’ মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ, আক্রান্ত ১শ’ ছাড়িয়েছে
মাঙ্কিপক্স নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
মাঙ্কিপক্স: দেশের সব বন্দরে সতর্কতা
মাঙ্কিপক্স কী
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মাঙ্কিপক্স হারিয়ে যাওয়া গুটি বসন্তের মতো, তবে তুলনামূলক কম গুরুতর এবং সংক্রমণ বেশি ছড়ায় না।
এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, গাঁট ও মাংসপেশিতে ব্যথা এবং দেহে অবসাদ।
জ্বর শুরু হওয়ার পর দেহে গুটি দেখা দেয়। এসব গুটি শুরুতে দেখা দেয় মুখে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে হাত এবং পায়ের পাতাসহ দেহের সব জায়গায়।
এই গুটির জন্য রোগী দেহে খুব চুলকানি হয়। পরে গুটি থেকে ক্ষত দেখা দেয়। জল বসন্তের মতোই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও দেহে এসব ক্ষত চিহ্ন রয়ে যায়।
রোগ দেখা দেওয়ার ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
১৯৫৮ সালে বানরের দেহে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হওয়ায় এর নামকরণ হয় মাঙ্কিপক্স। যদিও এখন ইঁদুরকেই বিস্তারের প্রধান পোষক হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
কীভাবে ছড়ায়
সংক্রমিত রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে এই ভাইরাস ছড়ায়।
আক্রান্ত ব্যক্তির কাপড়-চোপড় ও বিছানা থেকে ছড়ায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের ক্ষত থেকে এবং নাক, মুখ ও চোখের ভেতর দিয়ে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, এমনকি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বিছানাপত্র থেকেও এই ভাইরাস অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।
চিকিৎসা
এই ভাইরাসের কোন চিকিৎসা নেই। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গুটি বসন্তের টিকা এবং ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ রোধে সাহায্য করতে পারে।
যে কোনো ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মতোই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এর প্রকোপ রোধ করা যায়। যেহেতু এ রোগ প্রাণঘাতী নয় তাই এটি নিয়ে উদ্বেগের তেমন কারণ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মাঙ্কিপক্সের যে কঙ্গো ধরনটি অপেক্ষাকৃত ভয়ানক ধরা হয়, তাতে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ। আর পশ্চিম আফ্রিকা ধরনটিতে মৃত্যুর হার ১ শতাংশ।
তাহলে কী ঘটতে চলেছে?
বিবিসি লিখেছে, “আমরা জানি এই প্রাদুর্ভাব ভিন্নরকম, কিন্তু কেন তা জানি না।
এক্ষেত্রে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে, হয় ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়েছে কিংবা একই পুরনো ভাইরাসটি শক্তিশালী হতে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গা বেছে নিয়েছে।”
মাঙ্কিপক্স একটি ডিএনএ ভাইরাস। তাই এটি কোভিড বা ফ্লুর মতো এর দ্রুত রূপান্তর বা মিউটেশন হয় না। যাকে স্বস্তির কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ছবি: রয়টার্স
খুব সম্প্রতি একটি জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমান সংক্রমণগুলো ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের ভাইরাসের গঠনগুলোর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এটা খুব তাড়াতাড়ি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের নতুন ধরন বা মিউটেশনের কোনো প্রমাণ নেই।
একটি সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য ভাইরাসের রূপান্তরের কোনো প্রয়োজন নেই, যা গত দশকে ইবোলা এবং জিকা ভাইরাসের অপ্রত্যাশিত বড় প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক অ্যাডাম কুচারস্কি বলেন,“আমরা সবসময় ভেবেছিলাম, ইবোলাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ, আসলে তা সহজ ছিল না।”
এই ভাইরাসে কেন সমকামী এবং উভকামী পুরুষরা অসমভাবে আক্রান্ত হয়, তা স্পষ্ট নয়। যৌন আচরণ কি এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া সহজ করে তোলে? এটা কি শুধুই কাকতালীয়? কিংবা এমন কোনো কমিউনিটি রয়েছে যারা যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও সচেতন এবং তাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে?
বিবিসি লিখেছে, যৌন সংসর্গের কারণে মাঙ্কিপক্সের ছড়িয়ে পড়া সহজ হতে পারে। তবে অতীতের গণটিকাগুলো আগের প্রজন্মকে মাঙ্কিপক্সের মতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিছুটা সুরক্ষা দেবে।
অ্যাডলার বলেন, “এটি সম্ভবত গুটিবসন্তের যুগের তুলনায় আরও কার্যকরভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা এমন কিছু দেখছি না যে তা ব্যাপক আকার ধারণ করবে।”
কীভাবে এই প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল, তা বোঝার চেষ্টা ভাইরাসটি ভবিষ্যতে কী ঘটাবে তা অনুমান করতে সাহায্য করবে।
বিবিসি লিখেছে, “আমরা জানি, আমরা কেবল পানির নিচে থাকা বিশাল বরফখণ্ডের চূড়ার অংশই দেখতে পাচ্ছি। যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকগুলো সংক্রমণ খাপছাড়া যা ইউরোপ এবং তার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
রয়টার্স লিখেছে, সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বিশেষজ্ঞদেরও বিভ্রান্ত করছে। কেননা, যুক্তরাজ্যে গত ১৮ অবধি যে নয়জনের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাদের কেউ কারও সংস্পর্শে আসেনি। আর গত ৬ মে প্রথম যে রোগী ধরা পড়ে, ওই ব্যক্তি সম্প্রতি আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া গিয়েছিলেন।
ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড মহামারীর বিধি-নিষেধ উঠে যাওয়ায় মানুষের ভ্রমণ যেভাবে বেড়ে গেছে, তা মাঙ্কিফক্স সংক্রমণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
এই তত্ত্বের সমর্থক লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের অধ্যাপক জিমি হুইটওয়ার্থ রয়টার্সকে বলেন, “কাজ করতে গিয়ে আমি যেটুকু বুঝেছি, মধ্য আফ্রিকায় ভ্রমণ অনেক বেড়েছে, আর সেই কারণেই আমরা বেশি সংক্রমিত পাচ্ছি।”
অধ্যাপক জিমি হুইটওয়ার্থ।
বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে সাম্প্রতিক একটি বিশাল ইভেন্ট দিয়ে, যেখানে বিপুল সংখ্যক লোক জড়ো হয়েছিল এবং একই স্থানে মাঙ্কিপক্স ধরা পড়েছিল। তারপরে এটি বিভিন্ন দেশে বয়ে নিয়ে যায়।
অগণিত অনেক লোকের সংক্রমণের ব্যাপারে বিকল্প ব্যাখ্যা হল- ভাইরাসটি সবার অলক্ষে বুদবুদ আকারে ছড়িয়েছে কি না?
অধ্যাপক জিমি হুইটওয়ার্থ বলেন, এই পর্যায়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
“এটা মনে করি না যে আমরা এর সবকিছু উন্মোচন করেছি; আবার এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটাও মনে করি না। তবে মনে রাখবেন, আমরা কোভিডের সঙ্গে যেমন ছিলাম সেরকম অবস্থায় নেই।”
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঙ্কিপক্স একটি পরিচিত ভাইরাস। আর বসন্তের টিকাও রয়েছে। এটি প্রধানত মৃদু, যদিও ছোট শিশু, গর্ভবতী এবং দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
তবে এটি কোভিডের চেয়ে ধীরে ধীরে ছড়ায়। ভিন্নরকমের এবং ব্যাথাযুক্ত ফোসকা আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা কঠিন করে তোলে। এর ফলে যে কাজটি করতে হতে পারে তা হলো- সহজে সংক্রমিত হতে পারে বা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে টিকার আওতায় আনা।
তারপরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপের আঞ্চলিক পরিচালক হ্যান্স ক্লুজ সবাইকে সতর্ক থাকতেই বলেচেন।
“আমরা গ্রীষ্মের মওসুমে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে…সমাবেশ, উৎসব এবং পার্টি…আমি উদ্বিগ্ন এগুলো সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে পারে।”
“এটা কোভিডের মতো মহামারী নামিয়ে আনবে না হয়ত, তবে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিৎ,” বলছেন অধ্যাপক হুইটওয়ার্থ।