ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশে চলছে গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন।
জাতিসংঘের হিসাবে, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে বিক্ষোভ-সংঘাতে অন্তত ১৪৯ জনের প্রাণ গেছে। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এরপরেও থেমে নেই আন্দোলন। যারা শত বাধা সত্ত্বেও প্রতিনিদিন বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছেন, তাদের ভাষায়, তাদের গল্পগুলো তুলে আনা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
কন্যা সন্তানের আগামীর জন্য এক নারীর লড়াই
জেনারেল স্ট্রাইক কমিটি অফ ন্যাশনালিটিজের একজন নেতা নাও। নিজের এক বছর বয়সী কন্যা সন্তানের জন্য সুন্দর এক আগামীর প্রত্যাশা নিয়ে এই নারীও যোগ দিয়েছেন বিক্ষোভে।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু কারেন জনগোষ্ঠীর একজন হওয়াতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হয় তাকে।
“আজকের এই প্রতিবাদে সবাই এসেছেন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের মুক্তির দাবি নিয়ে। সবাই চায় ২০২০ সালের ভোটের ফলাফল যাচাই।”
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর চাওয়া এটুকুতেই সীমিত নয়।
“আমাদের দাবি আরো গভীর। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারের সব জাতিসত্তা নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
“সামরিক বাহিনী বহু বছর ধরে শাসন করে আসছে ‘বিভক্তি সৃষ্টি আর দখলের’ নীতি নিয়ে; কিন্তু এখন সব জাতিসত্তার মানুষ যুথবদ্ধ হয়েছে।”
নিজের এক বছর বয়সী মেয়ের কথা ভেবে নাও বলেন, “আমি চাই না সে আমার কারণে ভোগান্তির মুখে পড়ুক। আমি এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছি আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে; আমি চাই না সেও আমার মত স্বৈরতন্ত্রের ছায়াতে বেড়ে উঠুক।”
নাও তার স্বামীর সমর্থন নিয়েই সমাবেশে অংশ নিয়েছেন।
”আমি তাকে বলেছিলাম, আমার সন্তানের যত্ন নিতে। যদি আমি আটক হই, অথবা মারা যাই, তাহলে সে যেন জীবনে থমকে না থেকে এগিয়ে যায়। এই বিপ্লবের শেষ করতে হবে আমাদেরই; আমাদের উত্তরাধিকারের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।”
চিকিৎসকদের গ্রেপ্তার এড়ানোর পথ করে দেন যিনি
নান্দা কাজ করে মিক শহরের এক হাসপাতালে। মিয়ানমারের গণবিক্ষোভে একেবারে সামনের সারিতে রয়েছেস মেডিকেল কর্মীরা। তবে নান্দার ভাষ্যে, মিক শহরে যারা আছে তাদের সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়েই থাকতে হয়।
৭ মার্চের রাত; শহরে কারফিউ জারি করার ঠিক আগে।
”আমি কালো কাচের গাড়ি চালাচ্ছিলাম। একজন অর্থোপেডিক সার্জন, তার স্ত্রী, একজন ফিজিশিয়ান ও তার পরিবারকে তুলে নিলাম গাড়িতে। অন্ধকারের সুযোগে তাদের ব্যাগ গাড়িতেই গুছিয়ে নেওয়া হল। আমি তাদের নিরাপদ একটি বাড়িতে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলাম।”
এর ঠিক একদিন আগে প্রশাসন থেকে মিকের হাসপাতালগুলোকে যেসব বিশেষজ্ঞ, মেডিকেল কর্মকর্তা ও নার্সরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, তাদের নামের তালিকা দিতে বলা হয়।
“আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম; কেন এই নামগুলো চাওয়া হচ্ছে? যদি এদের তলব করা হয়, তবে তাদের কী হাল হতে পারে?”
সরকারি কাজে দায়িত্বরত সব চিকিৎসকই গা ঢাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ধরা পড়লে কী হতে পারে এই ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। আর এই চিকিৎকদের পালাতে সাহায্য করার দায়িত্ব দেওয়া হয় নান্দাকে।
গাড়ির ভেতর তখন সন্দেহ আর বিরক্তি মেশানো পরিবেশ।
একজন ফিজিশিয়ান বলে উঠলেন, “আমাদের মত চিকিৎসক আর মেডিকেল কর্মীদের কেন অপরাধীর মত পালিয়ে থাকতে হচ্ছে?”
ওই পরিস্থিতিতে নান্দা অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন।
“কোনোদিন ভাবিনি যে কোনো অপরাধ না করেও এভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে। …আগামী কাল থেকে মিক শহরে হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ থাকবেন মানুষের চিকিৎসার জন্য। পর্যাপ্ত সার্জন থাকবে না জান্তা বাহিনীর পিটুনিতে প্রতিবাদকারীদের ভাঙা আঙ্গুল, হাত, খুলি জোড়া লাগানোর জন্য।”
পরদিন থেকে মিক শহরে প্রসূতি মায়েদের জন্য কোনো ধাত্রী ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে না ভেবে শঙ্কিত হন নান্দা।
“ এই আন্দোলনে মেডিকেল কর্মীরা বড় একটা ভূমিকা রাখছিল, কিন্তু এখন তাদের সরে যেতে হল।”
ক্যামেরার পেছনের লোকটি
সিনেমা বানানোর কাজ করেন ইয়াংগনের মাউং। শুরু থেকেই মাউং ঠিক করেন, বিক্ষোভের প্রতিদিনের চিত্র ধরে রাখবেন; আন্দোলনটা কী করে এগোতে থাকে তার একটি তথ্যচিত্র হয়ে থাকবে।
মাউংয়ের জীবনে অবিস্মরণীয় একটি দিন হয়ে থাকবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। বারগায়া স্ট্রিটের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি; ব্যারিকেডের ঠিক পিছনে।
মোবাইল ফোনে আন্দোলনের ভিডিও ধারণ করছিলেন মাউং। শত শত বিক্ষোভকারী স্লোগান ও বোতল-ক্যান পেটানোর আওয়াজে মুখর ছিল।
“এ সময় প্রায় শ খানেক মানুষের একটি দল আমাদের দিকে মার্চ করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমি জানি না তারা পুলিশ ছিল না সেনাবাহিনীর লোক।“
মাউংয়ের ভাষ্যে, কাউকে সতর্ক না করেই তারা বিক্ষোভকারীদের দিকে স্টান গ্রেনেড, গুলি আর টিয়ারগ্যাস ছুড়তে থাকে।
“আমি দৌড়ে পাশের একটা গলিতে চলে যাই। ভিডিও নেওয়ার সময়ই পালানোর পালানোর পথটা দেখে রেখেছিলাম। আমাদের বেশির ভাগই পালাতে পেরেছিল।”
এখন আন্দোলনে গেলে মাথায় হেলমেট আর হাতে গ্লাভস পরে যান মাউং।
“আমরা এখন সুযোগ পেলে টিয়ার গ্যাসের শেল পাল্টা ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। ভেজা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে তারপর পানি ঢেলে এগুলো নিষ্ক্রিয় করা যায়। কেউ কেউ সস্তা গ্যাস মাস্ক পরত; যদিও এগুলো গ্যাস থেকে পুরোপুরি বাঁচাত না। তবে কোকাকোলা দিয়ে মুখ ধুলে গ্যাসের ক্রিয়া জলদি কেটে যেতে দেখেছি আমরা।”
একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং আন্দোলনকারী হিসেবে মাউং ঠিক করলেন, তিনিও বিক্ষোভে অংশ নেবেন; আর প্রতিদিন একটি করে শর্ট ফিল্ম বানাবেন।
”এখন যখন আমি ওই ফুটেজগুলো দেখি, আমি আবার উপলব্ধি করতে পারি, একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কী করে পাল্টে গেল, যেখানে আমাদের এখন জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে।… এসব যেন সিনেমাকেও হার মানায়।”
অবরুদ্ধ এক নারীর কথা
ইয়াংগনের এক এলাকা সানচাউং। এখানে ২০০ লোকের সঙ্গে প্রতিবাদে যোগ দেন গবেষক ফ্যো। মিলিটারিরা এসে বিক্ষোভকারীদের কোনঠাসা করে ফেলে। আটক হয় প্রায় ৪০ জন।
সেদিনের ঘটনার কথা বিবিসির কাছে বর্ণনা করলেন ফ্যো।
৮ মার্চের দুপুর ২টা। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর একটি দল এসে বিক্ষোভকারীদের ঘিরে ফেলে।
“আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন তাদের ঢুকে ঘুরে পড়তে আমাদের হাতের ইশারায় ডাকতে থাকে। বাইরে জান্তার লোকেরা দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা কখন বেড়িয়ে আসি সেই অপেক্ষা…। আমরা সাতজন ছিলাম তখন একটি বাড়িতে; ছয়জন নারী ও একজন পুরুষ।”
বাড়ির লোকেরা আশ্রয় নেওয়া বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সদয় ছিল। তারা খাবার বন্দোবস্তও করে।
“আমরা ভেবেছিলাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে এলে সমস্যা হবে না। কিন্তু যখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা, আমরা ভয় পেতে শুরু করলাম।”
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা তখনও বাইরে অপেক্ষায় ছিল।
”আমরা পালানোর পরিকল্পনা করলাম। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখানেই আমাদের জিনিসপত্র রেখে দিলাম। আমি কাপড় পাল্টে সারং (স্কার্টের মত স্থানীয় পোশাক) পরে নিলাম, যাতে আমাকে দেখতে এখানকার একজনের মতই লাগে। এরপর ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। ”
সাবধানতা হিসেবে নিজের ফোন থেকে বিভিন্ন অ্যাপও মুছে ফেলেছিলেন ফ্যো। সঙ্গে নিয়েছিলেন কিছু খুচরো টাকা।
“আমরা আরেকটি নিরাপদ আশ্রয় পুরো রাতটা কাটাই। সকালে জানতে পারি বাহিনীর লোকেরা আর অপেক্ষায় নেই বাইরে।”